মনে আছে বুড়িবালামের যুদ্ধ? আসুন, আমার সাথে ঘুরে নিন সেই বুড়িবালাম নদীর তীর।

in আমার বাংলা ব্লগ5 months ago

।।ঐতিহাসিক বুড়িবালামের প্রান্তর।।


🌱🌱🌱🌱🌱🌱🌱🌱🌱


AddText_07-10-11.05.59.jpg


☘️ছোট্ট ভ্রমণে ঘুরে এলাম বুড়িবালাম নদীর তীর। এই সেই ঐতিহাসিক স্থান যেখানে জুড়ে আছে বীর বিপ্লবী বাঘাযতীনের নাম☘️

1720541507968-removebg-preview.png


☘️ সকলকে স্বাগত জানাই ☘️

বুড়িবালামের যুদ্ধের কথা মনে পড়ে? ইংরেজদের বিরুদ্ধে দেশীয় বিপ্লবীদের আগুন তখন তুঙ্গে। বন্দুক ধরে সম্মুখ মোকাবিলা করছেন ভারতবর্ষের আপামর যুব সমাজ। চারিদিকে যুগান্তর দল, অনুশীলন সমিতির মতো বিভিন্ন গুপ্ত সমিতি গড়ে উঠেছে। মুজফফরপুরে অত্যাচারী কিংসফোর্ড সাহেবকে হত্যার চেষ্টা করার অপরাধে দায়ী হয়েছেন ক্ষুদিরাম বসু, প্রফুল্ল চাকীরা। সেই সময়ই আর এক বাঙালী অগ্নিপুত্রের নাম বাঘাযতীন। ওরফে যতীন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়। ইংরেজ বিরোধী আন্দোলনে সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়ে তিনি যে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পেরেছিলেন তা একসময় ইংরেজদের বেশ নাড়িয়ে দিয়েছিল। তাঁর জীবনের শেষ লগ্নে উড়িষ্যায় বালাসোরের কাছে বুড়িবালামের যুদ্ধ স্বাধীনতা সংগ্রামের এক উল্লেখযোগ্য অধ্যায়। বুড়িবালামের তীরে সেদিন আসবার কথা ছিল জার্মানির অস্ত্রবোঝাই তিনটি জাহাজ। তার মধ্যে একটির নাম মাভেরিক৷ বাঘাযতীনের মত দৃঢ় প্রতিজ্ঞ কিছু যুবক গোপনে জার্মানির সাথে যোগাযোগ করে প্রচুর অস্ত্র কিনে তা বাংলায় আনার ব্যবস্থা করেন৷ এমনই কঠিন ছিল তাঁদের সংকল্প। ভাবা যায়? কীই বা তাঁদের বয়স? তাতেই কী অসাধারণ প্রজ্ঞা। সেদিন তাঁদের সংগ্রাম হয়ত সফল হয়নি। কিন্তু ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের সঙ্গে জুড়ে গেছে তাঁদের নাম৷ বাঙালীর কাছে আজও অমর ও প্রাতঃস্মরণীয় তাঁরা।

IMG_20240616_134853_068.jpgIMG_20240616_134829_583.jpg

বুড়িবালামের তীর

সম্প্রতি আমার সৌভাগ্য হল সেই ঐতিহাসিক স্থান নিজে গিয়ে দেখে আসার। ছুঁয়ে এলাম উড়িষ্যায় বালাসোরে অবস্থিত বুড়িবালাম নদীর পাড়৷ যেখানে আজ থেকে ঠিক একশো দশ বছর আগে বাঘাযতীন, নরেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য, মানবেন্দ্রনাথ রায়, ডা: যদু গোপাল মুখোপাধ্যায়রা তাঁদের জীবনের কঠিনতম লড়াইটা লড়েছিলেন, সেই জায়গায় আমি দাঁড়িয়ে রোমাঞ্চিত হলাম। যেন চোখের সামনে দেখলাম সেদিনের সেই রক্তক্ষয়ী সংগ্রাম, যেখানে কিছু বাঙালী বীর যুবকের পিস্তল গর্জে উঠেছিল ইংরেজ সরকারের হাজার হাজার প্রশিক্ষিত সৈনিকের সামনে। তাঁদের বীরগাথা মাখা স্থানে নিজে দাঁড়িয়ে কোথায় যেন হারিয়ে গেলাম৷ আমার সাথে যাওয়া সফরসঙ্গীদের আর কেউই সেখানে তেমন আকর্ষণবোধ করলেন না। কেনই বা করবেন? কীই বা আছে সেখানে? সামান্য নিরীহ এক নদী, আর ধুধু প্রান্তর৷ আমি নেহাত ইতিহাস পাগল এক উন্মাদ। ভাঙা বাড়ি আর পুরনো ইট দেখলে ছুটে যাই সেখানে। তাই বুড়িবালামের তীরে দাঁড়িয়ে যে অনুভূতি আমায় ছুঁয়ে গেল, তা বলে বোঝানোর নয়৷ আহা, কী সৌন্দর্য সেই জায়গার৷ নদীর দুই পাড়ে প্রচুর সবুজের সমাহার। সাথে সারি দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে মাছ ধরার নৌকা৷ অসাধারণ তার সৌন্দর্য।

IMG_20240616_134913_321.jpg

বুড়িবালামের তীরে আমি

যেন এই বিগত একশো বছরে একটুও বদলায়নি জায়গাটা৷ আজও বুড়িবালাম নদীর তীর বেশ খালি। কংক্রিটের জঙ্গল জায়গাটার দখল নিতে পারেনি৷ বুড়িবালাম নদীর উপর দিয়ে চলাচল করে অসংখ্য মাছ ধরার ট্রলার। একসময় যে নদীপথে আসবার কথা ছিল জার্মান জাহাজ মাভেরিকের, আজ সেই নদীর পাশে দাঁড়িয়ে দেখছিলাম অহরহ নৌকার যাতায়াত। সেইখান থেকে সমুদ্রের খাঁড়ি খুবই কম দূরত্ব। তাই নদীতে জল প্রচুর। অনেক খোঁজ খবর করবার পর স্থানীয় একজন আমাকে জানালেন এই নদীর পাশেই জঙ্গলাকীর্ণ এলাকায় আত্মগোপন করেছিলেন বাঘাযতীনরা। কিন্তু সাধারণ মানুষ জন খুব একটা জ্ঞাত নয় সেই বিষয়ে। সেদিন ইংরেজ গভর্নর খবর পেয়ে যাওয়াই মাভেরিক জাহাজও আর গন্তব্য পর্যন্ত আসতে পারেনি, আর বাঘাযতীন সমেত তরুণ স্বাধীনতা সংগ্রামীর দলও বিজয় তোরণ ওড়াতে পারেনি বালাসোরের বুকে।

IMG_20240616_134829_583.jpg

বুড়িবালামের তীর

আমি বালাসোর পৌছানো থেকেই রোমাঞ্চিত ছিলাম বুড়িবালাম নদীর তীরে যাবার জন্য। বাঘাযতীনকে নিয়ে বাননো কিছুদিন আগে মুক্তিপ্রাপ্ত একটি বাংলা ছায়াছবিও দেখেছিলাম। কিঞ্চিৎ ইতিহাস নিয়ে আগ্রহ থাকায় বুড়িবালামের তীরে একবার পৌঁছানোর তীব্র আকর্ষণ আমি এড়িয়ে যেতে পারিনি। বাঘাযতীনদের মত লড়াকু বাঙালি সৈনিকদের নিজের চোখে দেখিনি, কিন্তু তাদের চরণধন্য সেইসব লড়াই এর জায়গা চোখে দেখার আকর্ষণ থেকে দূরে থাকা অত সহজ নয়। তাঁরা লড়াইটা করেছিলেন সামনে থেকে। অকুতোভয় সেইসব বাঙালী যুবকদের কথা আজও বিনম্র চিত্তে স্মরণ করি আমরা। আর তাঁদের স্মৃতিধন্য সেইসব অঞ্চলে গিয়ে দাঁড়ালে যেন শিহরিত হয় কৌতুহলী মন। বারবার মনে হয় এই সেই জায়গা যেখানে নিজেদের লড়াইয়ের সংকল্প নিয়ে পদচারণ করে গেছেন বাঘাযতীনের মত লড়াকু নির্ভীক বিপ্লবীর দল।

আজ বুড়িবালাম নদীর প্রান্তর আপনাদের সামনে তুলে আনতে পেরে আমার খুব ভালো লাগছে। অঞ্চলটি সামনে থেকে দেখার অভিজ্ঞতাই আলাদা। হয়তো এখানে লিখে বা ছবি দিয়ে সেই অনুভূতি ব্যক্ত করা সম্ভব নয়। কিন্তু বালাসোর থেকে বুকে করে বয়ে নিয়ে আসা সেই ব্যতিক্রমী অভিজ্ঞতা যতটুকু শেয়ার করে আপনাদেরকে সামিল করতে পারলাম, সেটাই আমার প্রাপ্তি। বালাসোর থেকে কলকাতা ফিরে এসেছি ঠিকই, কিন্তু বুড়িবালাম নদীর তীরে দাঁড়ানোর অভিজ্ঞতা বুকে স্থায়ীভাবে আঁকা হয়ে গেছে বরাবরের জন্য। আজ আর বাঘাযতীনরা নেই। ভারতবর্ষও স্বাধীন হয়ে গেছে বহু বছর হল। কিন্তু পড়ে আছে বুড়িবালাম। সেই সমস্ত দিনের স্মৃতি বুকে নিয়ে আজও নিরবে সাক্ষী দিয়ে যাচ্ছে প্রতিটি মানুষের সামনে।


(৫% বেনিফিশিয়ারি এবিবি স্কুলকে এবং ১০% বেনিফিশিয়ারি প্রিয় লাজুক খ্যাঁককে)


Banner_New.png


new.gif

1720541518267-removebg-preview.png


--লেখক পরিচিতি--

IMG_20240303_181107_644.jpg

কৌশিক চক্রবর্ত্তী। নিবাস পশ্চিমবঙ্গের হুগলি জেলায়। পেশায় কারিগরি বিভাগের প্রশিক্ষক। নেশায় অক্ষরকর্মী। কলকাতায় লিটল ম্যাগাজিন আন্দোলনের সাথে দীর্ঘদিন যুক্ত৷ কলকাতা থেকে প্রকাশিত কবিতার আলো পত্রিকার সহ সম্পাদক। দুই বাংলার বিভিন্ন প্রথম সারির পত্রিকা ও দৈনিকে নিয়মিত প্রকাশ হয় কবিতা ও প্রবন্ধ। প্রকাশিত বই সাতটি৷ তার মধ্যে গবেষণামূলক বই 'ফ্রেডরিক্স নগরের অলিতে গলিতে', 'সাহেবি কলকাতা ও তৎকালীন ছড়া' জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে। সাহিত্যকর্মের জন্য আছে একাধিক পুরস্কার ও স্বীকৃতি। তার মধ্যে সুরজিত ও কবিতা ক্লাব সেরা কলমকার সম্মান,(২০১৮), কাব্যলোক ঋতুভিত্তিক কবিতায় প্রথম পুরস্কার (বাংলাদেশ), যুগসাগ্নিক সেরা কবি ১৪২৬, স্রোত তরুণ বঙ্গ প্রতিভা সম্মান (২০১৯), স্টোরিমিরর অথর অব দ্যা ইয়ার, ২০২১, কচিপাতা সাহিত্য সম্মান, ২০২১ তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য।



কমিউনিটি : আমার বাংলা ব্লগ

ধন্যবাদ জানাই আমার বাংলা ব্লগের সকল সদস্যবন্ধুদের৷ ভালো থাকুন, ভালো রাখুন।


Sort:  

Upvoted! Thank you for supporting witness @jswit.

 5 months ago 

কিছুদিন আগে বাংলাদেশের এক মুক্তিযোদ্ধার জীবনী পড়তে গিয়ে বাঘাযতিনের নাম শুনেছি৷ কিন্তু কাহিনী জানতাম না। আপনার কাছ থেকে জানতে পেরে ভালো লাগছে। বালাসোর ঘটনা আমাদের উপমহাদেশের স্বাধীনতার আরেকটি স্তম্ভ বোধকরি। ধন্যবাদ, শেয়ার করার জন্য।

 5 months ago 

হ্যাঁ ভাই। ভারতীয় ভূখণ্ডের স্বাধীনতা লড়াইতে বাঘাযতীন এক সোনার নাম৷ তাঁর প্রজ্ঞা ছিল চোখে পড়বার মতন। তিনি ছুরি দিয়ে জঙ্গলে বাঘ মেরেছিলেন৷ সেই থেকে লোকে তাঁকে বাঘাযতীন বলতো৷ তাঁর বুড়িবালামের যুদ্ধ ইতিহাস প্রসিদ্ধ

 5 months ago 

জেনে ভালো লাগছে। ❤️