পর্ব -১ নামখানায় নিরুদ্দেশ (10% @shy-fox এবং 5% @abb-school এর জন্য বরাদ্দ)
যখন ট্রেনটা এই অচেনা প্রান্তিক স্টেশনে রূপকে নামিয়ে দিয়ে গেল, তখন সকাল সাড়ে সাতটা। ওর সঙ্গে একটা কাঁধব্যাগ ছাড়া আর কিছু নেই। কাঁধব্যাগে আছে প্রয়োজনীয় টুকিটাকি দ্রব্য। কলকাতা থেকে ট্রেনে চেপে নামখানায় আসতে লাগে তিন ঘণ্টা। ভোটের ট্রেন লেট করে না, তাও আজ কুয়াশায় লেট ছিল। দুদিন থাকবে, আশেপাশের গ্রামগুলো ঘুরবে। রবিবার রাতের ট্রেনে কলকাতায় ফিরবে। এই তার পরিকল্পনা।
রূপ কলকাতা পুলিশের হোমিসাইড শাখার ইনস্পেক্টর। এই নামখানা থেকে গত মাসে তিনজন বিবাহিতা মেয়ে নিখোঁজ হয়েছে। সেবিষয়ে তদন্ত করতেই তার এখানে আসা। এমনিতে গ্রামবাংলায় নিখোঁজ হবার ঘটনা নতুন কিছু নয়। থানাগুলোর হালও ভাল নয়। আর অনেক থানাতেই অপরাধীরা বড়বাবুর সঙ্গে যোগসাজশ করে পার পেয়ে যায়। কটা অভিযোগ আর উচ্চস্তরে গিয়ে পৌঁছায়? কিন্তু সেই নিখোঁজদের মধ্যে বেশিরভাগ হয় ছোট ছেলে, বা নাবালিকা মেয়ে। কিছু বৃদ্ধও অবশ্য হারিয়ে যান। নানান স্টেশনের গায়ে তাঁদের নাম, ছবি দিয়ে পোস্টার দেওয়া হয়। সঙ্গে থাকে সন্ধান দিলে পুরস্কারের কথা। গ্রাম বাংলার মানুষ এর চেয়ে বেশি আর কী-ই বা করতে পারে? তবু বিবাহিতা মেয়েদের নিখোঁজ হবার ঘটনা কাছে অদ্ভুত লেগেছে।
গত এক মাসে তিনজন গৃহবধূর নিখোঁজ হবার ঘটনা সমাজে তেমন আলোড়ন না ফেললেও এক সাংবাদিকের কল্যাণে তা খবরের কাগজে স্থান পেয়েছিল। অনুসন্ধানমূলক সাংবাদিকতা আজকাল পশ্চিমবঙ্গ থেকে উঠেই গেছে। অপাকাণ্ডের পরে সাংবাদিকরা এত সংবাদ ছাপাচ্ছেন, আর আগে তাঁদের কাছে কোনো সংবাদই ছিল না, এ বিশ্বাস করা যায় না। যাই হোক, সাংবাদিক শুভ্র মহান্তি সেই গোত্রে পড়ে না। ছোট পত্রিকা 'লিপি'র সাংবাদিক হয়েও সে একের পর এক অনুসন্ধানী প্রতিবেদন প্রকাশ করে চলে। তার চেষ্টাতেই এই কেসগুলো ডিসিডিডির কাছে পৌঁছেছে। তাঁর ইচ্ছেতেই রূপ সিংহকে তদন্ত করতে আসতে হয়েছে এই প্রান্তিক রেলস্টেশনে।
হোক প্রান্তিক স্টেশন, তবু গঙ্গাসাগর যাবার পথে শেষ স্টেশন হওয়ায় নামখানায় সারা বছর সারা ভারত থেকেই যাত্রীরা আসেন। তাঁদের মধ্যে পুণ্যার্থী সিংহভাগ, কেউ বা শুধুই ঘুরতে। এছাড়া বকখালি ঘোরার জন্যও নামখানা হয়েই অনেকে যাতায়াত করেন। তাই কেসগুলো সহজ ভাবলেও সহজ কিছুতেই নয়।
আজকাল চলভাষের কল্যাণে মানুষের গতিবিধি জানা সহজ। প্রতিটা মানুষ নিজের সঙ্গে এই বস্তুটির আশ্চর্য ক্ষমতা না জেনেই বহন করে চলে। আজকাল পুলিশের কাছেও কত উন্নত প্রযুক্তি আছে। তাই সহজেই অপরাধীদের ধরা যায়।
নিজের মনে এত কিছু ভাবছিল রূপ। হঠাৎ চটক ভাঙল পাশের লোকটার ডাকে। "ও মশাই, তখন থেকে এত কী ভাবছেন?", ব্যস্তসমস্ত হয়ে তাঁর জিজ্ঞাসা। হাল্কা হেসে রূপ বলল, "না তেমন কিছু না। সপ্তাহান্তে ঘুরতে এসেছি। এখানে কোথায় কম দামে ভাল হোটেল পাওয়া যায় বলুন তো।" চাকরির স্বল্প অভিজ্ঞতাতে রূপ জানে, কোথাও তদন্তে গেলে এই ধরনের হোটেল বা লজে ওঠাই সুবিধাজনক। আর বাংলার মানুষ পরের উপকার করতে মুখিয়ে থাকে। তাই এই সাহায্য চাইলে না পাওয়ার কিছুই নেই।
কিন্তু এই সকালে রূপের ভাগ্য প্রসন্ন নয়। ভদ্রলোক বললেন, "না, জানি না মশাই।" বলে নিজের সঙ্গে থাকা ব্যাগ নিয়ে স্টেশনের বাইরে যেতে পা বাড়ালেন। রূপ চোখ চেয়ে চেয়ে স্টেশনটাকে দেখছিল। যদিও সে গ্রামবাংলার ছেলে নয়, চাকরিসূত্রেও তাকে কোনোদিন গ্রামে বাস করতে হয়নি, নাগরিক স্বাচ্ছন্দ্য ছেড়ে গ্রামে স্থায়ীভাবে থাকার কথা সে ভাবতেও পারে না, তবু এই সকালে স্টেশন ও আশেপাশের এক সরল সৌন্দর্য তাকে মুগ্ধ করছিল। আপাতত ঘুমের আবেশ কাটানোর জন্য এক কাপ কড়া লিকার চা তার প্রয়োজন। সে চায়ের স্টলের দিকে পা বাড়াল।
স্টেশনে থাকা চায়ের স্টলটা এরমধ্যেই জমজমাট। দোকানী কয়লার আঁচ চড়িয়েছে। দুটো উনুনে পাশাপাশি দুধ চা ও জল ফুটছে। ভাঁড়ে এক কাপ লিকার চা দাও, জোরগলায় এই বলে দোকানের সামনের বেঞ্চিতে রূপ বসে পড়ল। বেশিরভাগ লোক দুধ চা-ই নেন, তাই লিকার চা হতে দেরিই হয়। এরমধ্যে সকালের পত্রিকাও এখানে চলে এসেছে। একটা 'বর্তমান' নিয়ে রূপ চোখ বোলাতে আরম্ভ করল।
'চিনি হবে, নাকি না?', দোকানী জানতে চাইল। হ্যাঁ, চিনি দিন, আদাও দিতে পারেন, বলল রূপ। দোকানী ভাঁড়ে চা ঢেলে রূপের দিকে বাড়িয়ে ধরল। আঃ, চায়ে চুমুক দিয়ে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল সে। কোথাও তদন্তে গেলে আগে স্থানীয় চায়ের দোকানে এক কাপ কড়া লিকার খাওয়া রূপের অভ্যাস। তার সিনিয়র অমৃতদাকেও সে এটাই করতে দেখেছে। হয়ত অবচেতনে তাঁকে নকল করতেই সে নিজেও এরকমই করছে। কোথাও গিয়ে চা খেয়ে তৃপ্তি না হলে তার মন খুঁতখুঁত করতে থাকে।
চা খেতে খেতেই তার চলভাষ বেজে উঠল। ধুর, এত সকালে আবার কে বিরক্ত করছে? আরাম করে চায়ে চুমুক দেবার মাঝে আবার বেজে উঠল। বিরক্তি গোপন করে দ্রুত পকেট থেকে বের করল সে।
একি! এ তো তার অমৃতদার ডাক। "হ্যাঁ, স্যর বলুন", কানে চাপল রূপ।
"ঠিকঠাক পৌঁছৈছ? এখন কোথায়?", ওপাশ থেকে বললেন হোমিসাইডের বরিষ্ঠ ইন্সপেক্টর অমৃত নস্কর।
"নামখানায় নেমেছি। এখন স্টেশনে বসে চা খাচ্ছি," বললে রূপ।
"সেই চা খাবার অভ্যাস আর গেল না তোমার," ওপারে শব্দ করে হেসে উঠলেন অমৃত। "যাক যা বলছি, চোখ-কান খোলা রেখে কাজ করবে। নিজের পরিচয় সহজে কাউকে দেবে না। আর হ্যাঁ, রিভলভারটা তোমার পকেটে রাখতে ভুল যেন না হয়। দিনে দুবার করে আপডেট জানাবে আমায়," অপরিসীম মমতায় পুত্রসম সহকর্মীকে নির্দেশ দিলেন তিনি।
"হ্যাঁ স্যর, ঠিক আছে" বলে ফোনটা কাটল রূপ। চা ইতোমধ্যেই ঠান্ডা হয়ে গেছে। দোকানী জিজ্ঞেস করল, "আরেককাপ খাবেন নাকি দাদা?"
"হ্যাঁ দাও, একদম কড়া লিকার, চিনি সহ", বলল রূপ। এখন দোকানের চারপাশে একটু দেখল। গ্রামবাংলার এই মধুর পরিবেশের মজাই আলাদা। আর শীতকাল বলে আরওই ভাল লাগছে।
পরের কাপ চা এল। বিল মিটিয়ে রূপ জিজ্ঞেস করল, দুদিনের ছুটিতে এখানে ঘুরতে এসেছি। একটা মাঝারি হোটেলে উঠব। আপনার জানা আছে নাকি?
"কী যে বলেন স্যর, হোটেল জানব না আমি? আমার বাপ-ঠাকুর্দার সময় থেকে এখানের বাসিন্দা। আপনি এক কাজ করুন, সোজা নেমে ডানদিকে যান। গিয়ে দেখবেন রঞ্জন লজ। এটাই এখানের সবচেয়ে ভাল হোটেল।"
"কত খরচ হবে? অত ভাল হোটেল না হলেও হবে। শুধু বাথরুমটা পরিষ্কার হলেই হবে আমার," বলল রূপ।
"আর আছে রামকৃষ্ণ সেবাশ্রম। স্টেশন থেকে নেমে বাঁদিকে গেলে যাকে জিজ্ঞেস করবেন পেয়ে যাবেন," বলে দোকানী বাকি ক্রেতাদের সামলাতে মনোনিবেশ করল। নিজের ব্যাগটা দোকানের বেঞ্চি থেকে তুলে কাঁধে ফেলে রামকৃষ্ণ সেবাশ্রমের উদ্দেশ্যে রূপ হাঁটতে শুরু করল।
(ক্রমশঃ)
তোমার কিন্তু লেখার হাত আছে। চালিয়ে যাও।
আচ্ছা বেশ। দেখি।