বিকৃত বধ | পর্বঃ ০৫ (সমাপ্ত) | ধারাবাহিক থ্রিলার গল্প
গল্পঃ #বিকৃত_বধ।
পর্বঃ ০৫ (অন্তিম পর্ব)
লেখকঃ মেহেদী হাসান রাব্বি
"কেড়ে নেই।"
আফসানার সেদিনের বলা কথাটা বারবার রাফির স্বপ্নে এসে উঁকি দিচ্ছিলো। বিছানার মধ্যে এপিঠ-ওপিঠ করতে করতে একটা সময় রাফির ঘুম ভেঙে যায়। চোখ মেলে হুড়মুড়িয়ে শোয়া থেকে উঠে বসে সে। জোরে জোরে নিঃশ্বাস নিতে থাকে রাফি। যেন মনে হচ্ছে কেউ তার শ্বাস-প্রশ্বাস চলাচলে ব্যাঘাত ঘটাচ্ছে। মাথার উপর ফ্যান ঘুরলেও সে ঘেমে একাকার। রাফিরা তৃতীয় ফ্লোরে থাকে। তন্মধ্যে রাফির রুমটি তাদের বাড়ির বাগান বরাবর। জানলা দিয়ে মৃদু হাওয়া সবসময়ই আসতে থাকে। আজ যেন হাওয়ার সাথে সাথে জানালা দিয়ে একরাশ ভয় রাফির রুমে প্রবেশ করেছে। তার কানে একটি শব্দই বারবার জোরে জোরে বাজছে।
"কেড়ে নেই!"
ঘড়িতে তাকিয়ে সময়টা দেখে নিল রাফি। ঠিক রাত দুইটা। মনে মনে চিন্তা করল এখন হয়তোবা হারকিউলিস কাউকে না কাউকে খুন করছে। কেমন হবে সেই যন্ত্রণা? বিকৃত এই হত্যার কষ্ট কতটা বিকৃত তা হয়তোবা রাফি অনুভব করতে পারছে না। বালিশের পাশেই চার্জে লাগানো অবস্থায় ফোনের দিকে নজর গেলো তার। কি যেন মনে করে ফোনটা হাতে নিয়ে সোজা হয়ে বসল সে। মনে মনে বলল,
"আচ্ছা আমি যদি এবার আফসানাকে ফোন দেই তাহলে কী হবে? ও যদি নিজেই হারকিউলিস হয়? তাহলে হয়তোবা সেই ফোনের শব্দে খুন হওয়া থেকে বেঁচে যাবে সেই লোকটি। হয়তোবা সেই ফোনের রিংটোনের শব্দে বাড়ির লোকজন জেগে উঠবে, হাতেনাতে ধরবে হারকিউলিসকে!"
আবার হঠাৎ কি মনে করে ফোনটা বালিশের পাশে রেখে দিল রাফি। সে এসব কী ভাবছে! আফসানা কোন হিসেবে হারকিউলিস হবে! আজ রাতেই তো মামুর সাথে কথা হলো। হারকিউলিস কে তা এখনো সঠিকভাবে কনক্লিউশন দিতে পারেনি মামু। ভালোবাসার মানুষটিকে হারকিউলিস ভেবে এভাবে অপমান করাটা হয়তোবা ঠিক হয়নি ওর কাছে। রাফি অনুতপ্ত। ভালোবাসা... আফসানা মেয়েটা রাফির থেকে কম হলেও তিন বছরের বড়। তবুও এক অদ্ভুত টানে একটি দিনও তাকে দেখা ছাড়া থাকতে পারে না সে। ঘটনাটি রাফি কাউকে জানায়নি। জানালে এই সমাজ মানতো না। বয়সের দিক দিয়ে তো মানতোই না, তার উপর আফসানা একজন ধর্ষিতা।
প্রথম যেদিন আফসানার সাথে রাফির দেখা হয়, সেদিন রাফি তার নাম নিতেই আফসানা একটি কথা বলেছিল।
"ধর্ষিতাদের নাম নিলে সমাজ তোমাকে পঁচা বলবে।"
সমাজ রাফির কাছে এখন তুচ্ছ জিনিসে পরিণত হয়েছে। তবে আফসানা যদি আসলেই হারকিউলিস হয় তখন?
রাফির আর ঘুম হলো না। মোবাইলটা নিয়ে চট করে কল লাগাল আফসানাকে। বুকটা ধুকপুক করছে তার। এত রাতে একটি মেয়েকে ফোন দেওয়া ঠিক না বেঠিক তা জানেনা রাফি। কিন্তু অদ্ভুত এক কারনে তার হাত সয়ংক্রিয়ভাবে কাজ করছে।
আফসানাকে দুইবার কল দিল রাফি। দুইবারই ফোন রিসিভ হলো না। তৃতীয় বার ফোন দিতেই ওপাশ থেকে কে যেন ফোনটা ধরে হ্যালো বলে উঠলো। এই গলা টি যে আফসানার না, এটা বেশ ভালোমতোই টের পেল সে। মোটা একটা গলা। তাও আবার পুরুষ কন্ঠ।
"আসসালামু আলাইকুম আঙ্কেল। আফসানা আছে?"
"এত রাতে ফোন দিয়ে আফসানার কথা জিজ্ঞেস করো। কে তুমি?"
"আসলে আমি ওর অফিস কলিগ। আজ ভুলে ওর একটি ফাইল আমার কাছে চলে এসেছিল। মাত্র ফাইলগুলো চেক করতেই চোখে পড়ল। তাই ভাবলাম ওকে জানিয়ে দেই। কাল শুক্রবার, অফিস বন্ধ।"
"ও আচ্ছা। কিন্তু বাবা ও তো ঘুমিয়ে রয়েছে। আর ওর সাথে ঘটনাগুলোর কারণে রাতের বেলা মোবাইল ওর কাছে থাকে না।"
"আচ্ছা আঙ্কেল আপনি যদি কিছু মনে না করেন একটা প্রশ্ন করতে পারি?"
"হ্যাঁ করো?"
"আপনি কি হন আফসানার?"
"আমি ওর খালু হই। এখানে চিকিৎসার জন্য এসেছি গ্রাম থেকে।"
"ও আচ্ছা ঠিক আছে। আমি সকালে ফোন দেবোনে। আচ্ছা আঙ্কেল আল্লাহাফেজ।"
রাফি মোবাইলটা রেখে শুয়ে পরল। ঘড়িতে ঠিক দুইটা বেজে ত্রিশ মিনিট। হারকিউলিস মনে হয় এখনো খুন করেই চলেছে। আজেবাজে কথা ভাবতে ভাবতে কখন যে সকাল হয়ে গেল রাফি টের পেল না। সকাল সাতটা বাজে মিসেস নূরজাহান রাফি কে ডাকতে ডাকতে বিরক্ত হয়ে নিজের কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। এদিকে সাড়ে সাতটায় রাফির ঘুম ভাঙতেই তড়িঘড়ি করে উঠে কোনমতে রেডি হয়ে বেরিয়ে পড়ল সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের উদ্দেশ্যে। সেখানে পৌছাতে আরো বেশ কিছু সময় চলে গেল। পৌনে আটটা বাজে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের গেটের সামনে পৌঁছালো সে। তবে আশ্চর্যজনকভাবে কোথাও আফসানাকে দেখতে পেল না। আশেপাশে তাকাতেই হঠাৎ পেছন থেকে রাফির মাথায় টোকা দিল আফসানা।
"কী মিস্টার গোয়েন্দা, রাতে ঘুম হয়নি বুঝি?"
"সত্যি বলতে শুরুর রাতে ঘুম হয়নি। ভোরবেলায় ঘুম চলে আসে।"
"রাত্রি জেগে জেগে কার কথা চিন্তা করা হয়?
কার নাম এই মনেতে লয়?"
"আজ হঠাৎ কবি হয়ে গেলে যে?"
"আরে না এমনি। চলো হাঁটতে যাই।"
আজ আফসানার খালাতো ভাই শুভ আসেনি। শুভর অনুপস্থিতিতে রাফির সন্দেহ আরো বেড়ে গেল।
"শুভ আসেনি আজকে?"
"ওর নাকি কাবাব মে হাড্ডি হতে ভালো লাগে না।" হাসিমুখে বলল আফসানা।
দুজনেই পায়ে পা মিলিয়ে হাটছে। হাঁটতে হাঁটতে বেশ কিছুক্ষণ সময় কেটে গেল।
"আজ অফিস ছিল না তাই এত সময় এখানে থাকতে পেরেছি। যেতে হবে রাফি। খালা খালু এসেছে তো বাসায়। মা তো নেই। বাবাও.. তাই সব কাজ আমাকেই করতে হয়। আজ আসি। আবার আগামীকাল দেখা হবে।"
রাফিকে বিদায় দিয়ে আফসানা প্রতিদিনকার মত হাঁটতে শুরু করল। প্রতিদিনের মত যতক্ষণ পর্যন্ত আফসানাকে দেখা যায় ততক্ষণ, সেই পথেই চেয়ে রইল রাফি। কী মনে করে পেছনে ঘুরতেই ভূতের মত তাকিয়ে থাকা রবিকে দেখতে পেয়ে চমকে উঠলো রাফি। সে কিছু বলতে যাবে তার আগেই রবি তাকে তার মাথাটি সোজা করে আফসানা যেদিকে হাটছিল সেই দিক বরাবর তাকাতে বলল।
"দেখ রাফি সেই চিকুনচাকুন দেহ। উচ্চতাও হারকিউলিসের মতন। মেয়ে, গোলাপ ফুল! কোথাও কিছু একটা মিল পাচ্ছিস?" ফিসফিস করে বলল রবি।
রাফি একরাশ বিরক্তি নিয়ে মাথাটি রবির দিকে ঘুরিয়ে বলল,
"মামু, ছেলেদের বডি স্প্রে, ছেলেদের কন্ঠ, ছেলেদের মতন শক্তি, কোথাও কিছু অমিল পাচ্ছো না তুমি? ও হ্যাঁ, শুধু ছেলেদের মত কন্ঠ না। একটা ভারী কন্ঠ! অনেকটা বৃদ্ধ লোকের ক...!"
রাফি আর কিছুই বলল না। হঠাৎ থেমে গেল। রবি কিছু বলতে যাবে তার আগেই পকেটে রাখা মোবাইলটি বের করে ভয়েস রেকর্ড অপশনে যেয়ে একটি অডিও ফাইল ওপেন করল। যেহেতু তার মোবাইলে অটো কল রেকর্ড অপশন চালু ফাই অডিওটা আফসানার খালুর সাথে কথা হওয়ার সময় হয়েছে। অডিও ফাইলটি যত শেষের দিকে যাচ্ছে তাদের দুজনের চেহারার আকার এবং ইঙ্গিত ততই পাল্টাচ্ছে। রাফি কিছু বুঝে ওঠার আগেই রবি খপ তার শার্ট চেপে ধরে জিজ্ঞেস করে,
"এই হুবুহু মিল গলা কার বল আমায়!"
"আফসানার খালুর!" অশ্রুসিক্ত নয়নে বলল রাফি।
"কোথায় ওই মেয়ে!"
রাফি তোতলাতে শুরু করল।
"ও...ও... ঐদিকে!"
রবি রাফির হাত ধরে আফসানা যে রাস্তায় গিয়েছে সেদিকে দৌড় দিল। তবে দুর্ভাগ্যবশত ততক্ষণে আফসানা তাদের থেকে অনেক দূরে চলে গিয়েছে। একটা চায়ের দোকানের সামনে এসে থমকে গেল দুজনেই। রবি আফসানাকে না পেয়ে ঠাস করে চড় বসিয়ে দিলো রাফির গালে।
"গাধা কোথাকার। এইভাবে তুই হারকিউলিসকে ধরবি? হারকিউলিসের গলার স্বরই তোর মনে নেই।"
"আমি আসলে মামু...।" রাফি কান্না করে দিল।
"চুপ! একদম চুপ। এক্ষুনি আফসানাকে ফোন দে। ফোন দিয়ে বল তার সাথে তোর জরুরী কথা আছে।"
রবির কথা মত রাফি আফসানাকে কল করল। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত আফসানার ফোন বন্ধ ছিল। রবি সময় নষ্ট না করে এসপি তরিকুল ইসলামকে ফোন দিয়ে এদিকে আসতে বললেন। আর রাফিকে বললেন প্রতি মিনিটে একবার করে ফোন দিতে। হারকিউলিসকে এত কাছে পেয়েও ছাড়ার কোনো মানেই হয় না। রাফি ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করলো,
"তোমার কী মনে হয় মামু? আফসানাই কি হারকিউলিস?"
"আমার ওই পুরো পরিবারকেই সন্দেহ হচ্ছে। যতক্ষণ না পর্যন্ত আমি ওই পরিবারের কাউকে না কাউকে হাতের কাছে পাবো তুই ফোন দিতে থাক।"
কিছুক্ষণ পর ঘটনাস্থলে উপস্থিত হন এসপি তরিকুল ইসলাম। রাফির কাজের কথা শুনে তিনি নিজেও বেশ অবাক হন। প্রায় ৩০ মিনিট চেষ্টা করার পর আফসানার মোবাইলে ফোন ঢুকে।
"কথা বলার সময় একদম শান্ত থাকবি, যেভাবে তুই নরমালি কথা বলিস।"
রবির কথা শেষ হতেই ওপাশ থেকে ফোন রিসিভ করল আফসানা।
"হ্যালো।"
"আফসানা?"
"হুম মিঃ গোয়েন্দা, বলেন।"
"আসলে তোমার সাথে জরুরী একটা কথা ছিল আমার। যা আমি তখন বলতে পারিনি।"
"বলো কী বলবে?"
"ফোনে না। আমি সরাসরি বলতে চাই। আর এখনই বলতে চাই।"
"কী এমন কথা? মাত্রই তো ওখান থেকে আসলাম। আমাকে আবার এখন রান্না করতে হবে।"
"প্লিজ আফসানা, তুমি বোঝার চেষ্টা করো। তোমায় গতরাত আমার ঘুম না হওয়ার কারণ বলতে চাই, সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে হাটার সময় বারবার তোমার দিকে আড়চোখে তাকানোর উদ্দেশ্যটা বলতে চাই, যেই ছেলে সকাল এগারোটা ছাড়া বিছানা ছেড়ে উঠলো না সেই ছেলে ফজরের নামাজ পড়ে ভোর ছয়টা বাজে কেন ওঠে তার কারণ বলতে চাই। আমাকে তুমি এই অধিকার থেকে বঞ্চিত করো না আফসানা।"
কথাগুলো বলতে বলতে রাফির চোখ দিয়ে অনবরত পানি পড়তে লাগল। সে নিজে বুঝতে পারছে না এই কথাগুলো কি সে আফসানাকে ঠকানোর জন্য বলছে, না-কি তার মন থেকে বলছে।
"তুমি কান্না করছো?"
"আমার কিছু ভালো লাগছে না আফসানা। আমার ভালো লাগার একমাত্র মানুষ তুমি। আফসানা আমায় এই যন্ত্রণা থেকে মুক্তি দাও।"
"আচ্ছা তুমি কান্না করো না। তুমি কোথায় আছো এখন? আমি আসছি।"
"তুমি যেখানে রেখেছো আমি সেখানেই দাঁড়িয়ে আছি।"
আফসানা ফোন কেটে দিল। কথা শেষ হতেই রাফি হাঁটু গেড়ে বসে পরল। চোখ দিয়ে অনবরত অশ্রুপাত হচ্ছিল তার। সে বুঝতে পারল না, এই কাজটি আদৌ কি ঠিক হয়েছে কি-না। এস পি তরিকুল ইসলাম রাফির কান্না দেখে নিজেই ভেঙে পড়ল।
"রাফি, তুমি দুনিয়াতে দুই ভাবে চালাতে পারবে। একটি হচ্ছে নিজের আবেগ দিয়ে আর অপরটি, নিজের বুদ্ধি দিয়ে। নিজেকে যেকোনো একটি দিয়ে চালালে দুনিয়া চলবে। আর দুটি পথই সঠিক পথ। তুমি যদি মনে করো আফসানাকে তুমি ধোঁকা দিচ্ছো তাহলে দরকার নেই। তুমি ওকে ফোন দিয়ে বলে দাও তুমি দেখা করবে না। আর যদি মনে হয় যে না, তুমি ফোন দিয়ে তাকে ধোঁকা দিচ্ছ না। তুমি দেশের স্বার্থে, আইনের স্বার্থে, একটা ক্রিমিনালকে ধরার জন্য তাকে ব্যবহার করবে তাহলে তুমি নিজেকে শক্ত করো। এই দুটি পথের প্রথমটি হচ্ছে আবেগের পথ। আবেগ দিয়ে কাজ করলে তুমি আবেগী হবে। দ্বিতীয় পথটি হচ্ছে বুদ্ধির পথ। বুদ্ধি দিয়ে কাজ করলে তুমি বুদ্ধিমান হবে। মনে রাখবে, বুদ্ধিমানদের অতিরিক্ত আবেগ থাকতে নেই। আর আবেগীদের অতিরিক্ত বুদ্ধি থাকতে নেই।"
রাফি বেশ কিছুক্ষন চুপ করে রইলো। চোখের পানি মুছে হাত শক্ত করে উঠে দাঁড়াল সে।
"স্যার আপনি আরেকটি কথা ভুলে গেছেন। একজন গোয়েন্দার আবেগ এবং বুদ্ধি দুটোই থাকতে হয়। তা না হলে ক্রিমিনালদের সাথে খেলা যায় না! কেননা প্রতিটা ক্রিমিনালদের পেছনে থাকে একটি সুন্দর অতীত। আর সেই অতীত শুধুমাত্র এজন গোয়েন্দা বোঝে। আর কাউকে বোঝার জন্য আবেগ দরকার হয়!"
রাফির এরকম কথা রবি অবাক হয়ে গেল। কেননা এর আগে রাফি এতোটা সিরিয়াস কখনোই হয়নি।
.
.
রাফি চুপচাপ চায়ের দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। রবি এবং এসপি তারিকুল ইসলাম রাস্তার ওপাশে ছদ্মবেশ ধরে আছেন। বেশ কিছুক্ষণ অপেক্ষা করার পর ধীর পায়ে আফসানাকে এদিকটায় আসতে দেখল রাফি। আফসানা বরাবরের মতই বোরকা পরে এসেছে। এইরকম নম্র-ভদ্র একটা মেয়ে কিভাবে হারকিউলিসের সাথে জড়িত হয়, তা রাফির মাথায় আসে না।
"বলেন মিঃ গোয়েন্দা কী জন্য ডেকেছেন নামায়? কী আপনার গুরুত্বপূর্ণ কথা, শুনি এবার।"
রাস্তার ওপাশে থাকা এসপি তরিকুল এবং রবি দুজনেই কানে হেডফোন দিয়ে ট্রান্সমিটারের মাধ্যমে রাফি এবং আফসানার কথাগুলো শুনছিল।
"কী হলো রাফি? চুপ করে আছো যে? তোমার গুরুত্বপূর্ণ কথা বলবে না?"
"ইয়ে মানে কীভাবে যে শুরু করি।"
"আচ্ছা হাঁটতে হাঁটতে কথা বলি। এখানে দাঁড়িয়ে থাকা এমনিতেও অস্বস্তি লাগছে। তাছাড়া আমাদের কথাবার্তা হাঁটতে হাঁটতে হওয়াই সুখের, তাই না বলো?"
"হ্যাঁ তাই তো।"
মুখে একগাল হাসি নিয়ে বলল রাফি। তারা দুজনেই সোহরাওয়ার্দী উদ্যান এর উদ্দেশ্যে হাঁটা দিল। নির্দিষ্ট দূরত্বে থেকে পেছনে রবি এবং এসপি তরিকুল ইসলাম এগোচ্ছে। এসপি তরিকুল ইসলাম পকেটে হাত দিয়ে আছে। তার পকেটে একটি লোডেড রাইফেল আছে।
"আচ্ছা গত রাতে আমি ফোন দেওয়াতে ফোনটা কে ধরেছিল?"
"আমার খালু ছিলেন উনি। সকালে আমাকে বলেছে তুমি ফোন দিয়েছো। কিন্তু আমার মোবাইলে ব্যালেন্স ছিল না তাই ব্যাক করতে পারি নাই।"
"দাঁড়াও তোমাকে একটা জিনিস দেখাই।"
কথা শেষ করে রাফি পকেট থেকে মোবাইলটা বের করে হারকিউলিসের সেই কন্ঠটা আফসানাকে শোনালো। রাফির দৃষ্টি একবার মোবাইলের দিকে আরেকবার আফসানার দিকে তাকাচ্ছে।
"ও মাই গড, এটা হারকিউলিসের গলা!"
"হ্যাঁ, মিডিয়া এখনো জানে না। তাই টিভি রিপোর্টে এটার প্রতিবেদন আসেনি।"
"ভালো তো। আমিতো ওনাকে ব্যক্তিগতভাবে পছন্দ করি। আজকে ওনার কন্ঠস্বর শুনে নিলাম। এবার নিজেকে পরিপূর্ণ মনে হচ্ছে।"
"আচ্ছা দাঁড়াও আফসানা। আরেকটা রেকর্ড শোনো।"
এবার রাফি কল রেকর্ড ফাইলে রাতের রেকর্ডটি ওপেন করে আফসানাকে শোনাতে লাগলো। আগের বারের মতো এবারও রাফির চোখ একবার মোবাইল এবং আরেকবার আফসানার দিকে যাচ্ছে।
"এ তো আমার খালুর গলা। এ আর নতুন কী?"
কথা বলতে বলতে তারা একসাথে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের গেইটের সামনে চলে এসেছে। ভেতরে ঢুকে একটি বেঞ্চের উপরে বসলো তারা। রাফি আরেকটি মোবাইলে সেই কল রেকর্ড এবং তার হাতে থাকা মোবাইলটিতে হারকিউলিসের কণ্ঠস্বর একসাথে চালু করে আফসানাকে শোনালো। দুটোই হুবহু মিলে যাচ্ছে। আফসানা এবারও ব্যাপারটিকে তেমন গুরুত্বের সঙ্গে নিল না।
"তুমি এসবে কী বুঝাচ্ছো রাফি?"
"আফসানা, তোমার খালুই হারকিউলিস!"
"অসম্ভব! তিনি ঢাকায় এসেছেন নিজের চিকিৎসা করাতে। চিকিৎসা শেষে ছেলেকে নিয়ে গ্রামে চলে যাবে। ছেলের কয়েক মাস পর এসএসসি পরীক্ষা। আমাকে এখানে নিয়ে এসে কী দিয়ে কী বলছো তুমি?"
"আফসানা, হারকিউলিস ভালো কাজ করলেও তোমার মতে হারকিউলিস কখনো মহান হতে পারবে না। কেননা তুমি নিজেই বলেছিলে হত্যা করলেই কেউ মহান হয়ে যায় না। সে হত্যাকারীই থাকে।"
আফসানা আর কোন কিছুই বলল না। পাঁচ মিনিট একদম নীরবে নিস্তব্ধ কাটিয়ে দিল। একটি নির্দিষ্ট দূরত্বে আগের মতনই এসপি তরিকুল ইসলাম পকেটের মধ্যে থাকা রিভলবারটি ধরে আছে। তার হাত কাঁপছে। সে শুধু একটু ইশারা চাচ্ছে কখন আফসানা উল্টাপাল্টা কিছু করে এবং কখন তার লোড পিস্তল থেকে একটি পিতলের বুলেট ব্যয় হবে।
"তাই?" প্রশ্ন করল আফসানা।
"হ্যাঁ, তাই। আমি জানি এই হারকিউলিসের সাথে তোমার খালু জড়িত। হয়ত ওনার ছেলে শুভও এসবে জড়িত আছে। আমি নিশ্চিত হারকিউলিস একজন কোন ব্যক্তি না। তারা দুজন বা একাধিক হতে পারে। আমাদের প্রধান সাসপেক্ট তোমার ভাই শুভ এবং তোমার খালু। শুভর হাতের আঘাত আমাকে মনে প্রশ্ন জাগালেও আমিও ততটা গুরুত্ব দেইনি। কিন্তু যখন আমরা হারকিউলিসের দেহের গঠন পেয়েছি, তখন অনেকটাই নিশ্চিত যে হারকিউলিসের সাথে তোমার খালু এবং তোমার খালাতো ভাই জড়িত। আফসানা দয়া করে কোন কিছু লুকাবে না। তুমি আমাকে প্রথম দিন বলেছিলে আমার যে কোনো সাহায্য লাগলে তুমি আমাকে সাহায্য করবে। আর এখন তো আমাদের সম্পর্ক আরও অনেক গভীর। দয়াকরে সাহায্য করো।"
"আমাদের সম্পর্ক?"
বাঁকা চোখের দিকে তাকিয়ে বলল আফসানা। রাফি বুকে সাহস নিয়ে একটি লম্বা নিঃশ্বাস ফেলে বলল,
"হ্যাঁ, আমাদের সম্পর্ক। আমি তোমায় ভালোবেসে ফেলেছি আফসানা। আমি জানিনা তুমি কি মনে করবে, আমি জানিনা এই সমাজ কি মানবে, আমি জানিনা কে কী বলবে, কিন্তু আমি তোমাকে ভালোবেসে ফেলেছি। একদিন যদি তোমাকে না দেখে শুরু করি, বুকের মধ্যে অজানা কষ্ট অনুভূত হয়। তোমার বারবার আড়চোখে তাকানো, আমায় তোমার প্রতি দুর্বল করে দেয় আফসানা।"
"কিন্তু আমি তো ধর্ষিতা। তিনজন বীর পুরুষের হাতে ধর্ষিতা এক নারী। আমাকে তুমি পছন্দ করবে কোন দিক দিয়ে? আমার তো নিজের বলতে কিছুই অবশিষ্ট নেই রাফি। বরঞ্চ আমার তো মনে হচ্ছে তুমি আমার এই সুযোগ নিয়ে আমাকে সস্তা ভাবছ। মনে মনে বলছো ও তো আগে থেকেই ধর্ষিতা হয়ে আছে, ওর সাথে একটু সময় অপচয় করি না। দেখি কেমন লাগে।"
"আফসানা, এরকম ভাবে বলতে পারলে তুমি?" অবাক হয়ে বলল রাফি।
"অবাক হয়ে না রাফি। আমাদের দেশ, আমাদের এই প্রজন্ম এই রকমই। মনে নেই, কয়দিন আগেই তো হিয়া মনিকে কতগুলো নরপিচাশ ধর্ষণকরে হত্যা করল। খাদিজাদের তো সবাই ভুলেই গিয়েছে। আমাকে মনে রাখবে ক'জন? পুরুষতান্ত্রিক এই সমাজে সব নারীরা অবহেলিত নয়। যেই নারীদের ক্ষমতা নেই তারাই অবহেলার শিকার। তুমি একটু ভেবে দেখো রাফি, আজ পর্যন্ত কি কোন মন্ত্রী, ব্যবসায়ী কিংবা কোন ধনাঢ্য ব্যক্তির মেয়েরা ধর্ষণ হয়েছে? হয়নি। তাদেরকে কেউ ধর্ষণ করে না। ধর্ষিতা হয় আমাদের মত গরিব ঘরের মেয়েরা। যারা অসুস্থ বাবা মায়ের চিকিৎসার জন্য সাপে ভরা সমুদ্র পাড়ি দিয়ে অর্থ উপার্জনে নিয়োজিত হয়। কিংবা ছোট্ট শিশুরা, যাদের ঋতুস্রাপই ঠিকমতো শুরু হয়নি। আর নয় তো দুই তিন সন্তানের মায়েরাও ধর্ষণের শিকার হয়। আমাদের মত মধ্যবিত্ত কিংবা নিম্নমধ্যবিত্ত এবং গরীব ঘরের মেয়েদের সাথে এরকম হওয়ার বিচার সাধারণত হয় না রাফি। তাই এদের বিচার করার জন্য যুগে যুগে হারকিউলিস আবর্তিত হয়। রাফি আইনের প্রতি ধর্ষকরা কখনোই শ্রদ্ধাশীল না। আমি ধর্ষণ হয়েছি, কাল আমার বাবা একটি মামলা পর্যন্ত করতে পারে নাই। তাকে ছুরি চাপাতি দিয়ে কুপিয়ে মৃত্যুমুখে ঠেলে দিয়েছি। বাসায় এসে ভাঙচুর লুটপাট করে তুলে নিয়ে যায় আমার ছোট্ট ছয় বছরের বোনটাকে। আচ্ছা রাফি, তোমায় একটা প্রশ্ন করি, ছয় বছরের একটা মেয়ের দিকে কেউ আকৃষ্ট হয় কী দেখে? তোমার কাছে উত্তর আছে রাফি? আমি জানি নেই। তেমনি ভাবে আমার কাছেও তোমার প্রশ্নের কোন উত্তর নেই। হারকিউলিস যুগে যুগে আসবে। আজ এই হারকিউলিস মরে গেলে কাল অন্য হারকিউলিস দাঁড়িয়ে যাবে ধর্ষকদের পুরুষাঙ্গ বিচ্ছিন্ন করতে এবং অন্ডকোষের ভর্তা নিজের থুথু মিশ্রিত করে খাইয়ে দিতে। শুধু তাই নয় ওই সাদা ধবধবে শরীরে ব্লেডের লাল আচরের উপরে টাটকা লবণের প্রতিটা কণা ছিটিয়ে ছিটিয়ে ঘৃণা নিয়ে বলবে, ধর্ষক এবার দেখ কেমন লাগে!"
রাফি কোন কথা বলছে না। শুধু মাথা নিচু করে আফসানার কথা শুনছে।
"আফসানা, তুমি যদি আমাদের সাহায্য না করো তাহলে তোমার খালু এবং শু...।"
রাফির কথা থামিয়ে আফসানা হাসতে শুরু করলো।
"কী করবে তুমি রাফি? বড়জোর তাদেরকে জেলহাজতে ভরবে। তাদের মৃত্যুদণ্ড হবে। তারপর? তুমি কি মনে করো সমাজে আর কোন হারকিউলিস জন্মাবে না? হারকিউলিসকে ধরার জন্য তুমি ক্লান্ত হয়ে যাবে তবুও হারকিউলিসরা ক্লান্ত হবে না। তুমি একসময় এই কেসের প্রতি বিরক্ত হয়ে থেমে যাবে। কিন্তু হারকিউলিসরা তাদের মিশনের প্রতি কখনো বিরক্ত হয়ে থামবে না।"
"আফসানা আমি সব জানি কিন্তু তুমি ভুলে যেওনা আমি একজন আইনের লোক। আইনের প্রতি শ্রদ্ধা থাকাই আমার কাজ। আইন অন্ধ। সে প্রমাণ ছাড়া কিছু দেখে না।"
"প্রমাণ? আমি ওদেরকে তখনও কিছু বলতাম না। আমি মুখ বুজে সব সহ্য করে নিয়েছিলাম। মনে মনে ভেবেছি, আমি ধর্ষিতা হয়েছি রাতের আধারে। কেউ দেখেনি। কেউ জানেও না। তাই ব্যাপারটাকে আর বেশি বড় না করে আমি পরের দিনই অফিসে চলে গিয়েছিলাম। কিন্তু ওই জানোয়ারগুলো আমার বাবাকে এবং আমার বোনের যে অবস্থা করেছে তার জন্য আমি আমার মত পাল্টাতে বাধ্য হই।"
"মানে! কী বলছো এসব তুমি?"
রাফি, রবি এবং এসপি তরিকুল তিনজন চমকে উঠলো আফসানার কথা শুনে। এসপি তরিকুল ইসলামের হাত পিস্তলের উপরে এখনো কাপছে।
"ছয় বছরের একটি ছোট শিশুর যৌনিতে যেভাবে ওদের পাপীষ্ঠ পুরুষাঙ্গ ঢুকানোর জন্য ব্লেড দিয়ে কাটতে হয়েছে, ঠিক তেমনি আমি নিজ হাতে ছুরি দিয়ে ওদের পুরুষাঙ্গ কেটেছি! শুধু তাই নয় ওদের অণ্ডকোষ...।"
আফসানা কথা শেষ করার আগেই এসপি তরিকুল ইসলাম সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের গেট থেকে ভিতরে ঢুকে আফসানার উদ্দেশ্যে পিস্তল তাক করলো। আফসানা মুহূর্তের মধ্যে কোথা থেকে যেন একটি ছুরি বের করে রাফির গলা বরাবর ধরলো।
"আমি জানতাম রাফি তুমি এজন্যই আমাকে এখানে নিয়ে এসেছে। তাই আমি তোমাকে বারবার জিজ্ঞেস করেছি তুমি কি চাও আমি এখানে আসি। তুমি বলেছ হ্যাঁ, তুমি চাও। কিন্তু ভুলে যেওনা হারকিউলিস বিকৃত মস্তিষ্কের। আর বিকৃত মস্তিষ্কের মানুষেরা সাধারণত আবেগকে তেমন একটা প্রশ্রয় দেয় না।" রাফির কানে কানে বলল আফাসানা।
"চালাতে পারবে ওই ছুড়ি?" পিস্তল তাক করে প্রশ্ন করল এস পি তরিকুল ইসলাম।
"১৭ ই জানুয়ারি ২০১৯, বাংলাদেশের মাটিতে প্রথম হারকিউলিসের আঘাত আসে। কয়েকদিন পরে সেই হারকিউলিস এই দেশের আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোর বদৌলতে অদৃশ্য হয়ে যায়। হারিয়ে যায়। কিন্তু হারকিউলিসের এই ধারা থেমে যায়নি। আমি আফসানা আক্তার, সেই ধারার একজন! আমি দায়িত্ব নিয়েছি হারকিউলিসের। আজ আপনাদের এই আইন প্রয়োগকারী সংস্থা যদি আমাকে থামিয়ে দেয়, ভবিষ্যতে আরো অসংখ্য হারকিউলিস বের হবে যারা আমার থেকেও বিকৃত মস্তিষ্কের হবে। আর তাদের কোন আবেগ থাকবে না।"
কথা শেষ করতেই আফসানার চোখের কোনে পানি জমে এল। কেউ কিছু বুঝে ওঠার আগেই রাফির গলা থেকে ছুরিটা নিয়ে সজোরে নিজের পেটে ঢুকিয়ে দিল। মুহূর্তের মধ্যেই মাটিতে লুটিয়ে পরলো আফসানা। বিন্দুমাত্র সময় অপচয় না করে যত দ্রুত সম্ভব তাকে ধরাধরি করে সবাই হাসপাতালে নিয়ে গেল।
.
.
রবি, রাফি এবং এসপি তরিকুল ইসলাম হাসপাতালের অপারেশন থিয়েটারের বাইরে অপেক্ষা করছে। সবার চেহারাতেই চিন্তিত ভাব দেখা যাচ্ছে। রাফি মাথায় হাত দিয়ে চেয়ারে বসে রয়েছে। ভাগ্নের মন খারাপ দেখে রবি এক পা দু পা করে তার দিকে এগিয়ে গেল। রবিকে তার আসতে দেখে রাফি হাত বাড়িয়ে নিষেধ করল এখানে আসার জন্য।
"আমি ঠিক আছি মামু। আমার কিছুই হয়নি।"
"আইনের রক্ষার্থে আমি তোর ভালোবাসাকে দাড়িপাল্লায় মেপেছি, দর-কষাকষি করেছি। আমায় ক্ষমা করে দিস ভাগ্নে।"
"তুমি কিছুই করোনি মামু। যা করার আমাদের নিয়তি করেছে।"
কিছুক্ষণ পর অপারেশন থিয়েটার থেকে ডাক্তার বেরিয়ে এলো। সে জানালো অপারেশন সাকসেসফুল হয়েছে। রোগীর জ্ঞান আছে, সকলে চাইলে তার সাথে দেখা করতে পারে। সবার আগে রাফি দৌড়ে অপারেশন থিয়েটারে ঢুকলো। আফসানার হাতটা ধরেই মাটিতে বসে পড়ল সে। সবাইকে একসাথে দেখে আফসানা বলতে শুরু করল,
"ওই কন্ঠটা আমার বাবার। আর খুনগুলো করেছি আমি। এখানে শুভর কোন হাত নেই। ওকে আমি এমনিই নিয়ে এসেছিলাম।"
"তাহলে বডি স্প্রে টা?" প্রশ্ন করল এসপি তরিকুল ইসলাম।
"হাহাহা। গোয়েন্দারা আসলেই সন্দেহজনক। ছোট একটা বডিস্প্রেকেই এলিমেন্ট বানিয়ে নিয়েছে। বডি স্প্রেটা আমি শুভর থেকেই নিয়েছিলাম। ওটা ওর ছিল। ও আমাকে বডি স্প্রে দিয়েছিলো, এর বদলে আমার সাথে হাঁটতে বের হবার জেদ করেছিলো। আর সেই জন্যেই সেদিন সকালে ওকে নিয়ে হাঁটতে বের হই আমি। পলিথিনে রাখা পুরুষাঙ্গ গুলোর ভেতর থেকে পচা গন্ধ বের হচ্ছিল। সেই গন্ধ আটকানোর জন্যই বডি স্প্রে ইউজ করি।"
"তুমি না বললে তোমার বাবাকে ওরা...।"
কথা বলতে যেয়ে থেমে গেল রাফি।
"ওরা বাবাকে হত্যা করতে পারেনি রাফি। আমার বাবা মিটফোর্ডে ভর্তি আছে। তিনিই আমাকে এই ভয়েস রেকর্ড করে দিয়েছেন।"
"তুমি খুন করার সময় কোন কথা বলতে না। তুমি চাইলেই ওদের এমনিতেই মারতে পারতে। তাহলে এই টেপ রেকর্ডার কেন?" প্রশ্ন করলো রবি।
"ওদেরকে ভয় পাওয়ানোর জন্য! হারকিউলিসের কথা সবাই জানে। সেই হারকিউলিসের কথা দিয়ে ওদের মনে আমি ভয় ঢুকিয়ে দিতাম।"
"একজন মেয়ে হয়ে এতগুলো খুন করেছ। বুকে একটুও বাঁধেনি?" জিজ্ঞেস করল এসপি সাহেব।
"স্যার, তিনজন ছেলের দ্বারা আমি ধর্ষিত হয়েছি। আমার যোনিতে একই সঙ্গে তিন তিনটে পুরুষাঙ্গ প্রবেশ করেছে। এতো কিছু হয়ে যাওয়ার পরেও নিজেকে সামলে নিয়ে আমার ভাঙাচোরা পরিবারটাকে জোড়া লাগানোর কথা ভেবে ধর্ষিতা হওয়ার পরেরদিন আমি অফিসে যাই! আমার বুকে তখনই বাঁধেনি, আর এখন! এগুলো করতে তো আমার বেশ মজা লেগেছে। যে পুরুষ নিজের পুরুষত্ব সামলাতে না পেরে ধর্ষণ নামক নোংরা খেলায় মেতে ওঠে, তার পুরুষাঙ্গ কেটে দাও। তার পুরুষত্ব ধ্বংস হলে বদলে যাবে সমাজ, থেমে যাবে ধর্ষণ।"
"তাহলে তোমার সেদিনের কেড়ে নেওয়া মানে ধর্ষকদের জীবন কেড়ে নেওয়া বুঝিয়েছিলে?" জিজ্ঞেস করলো রাফি।
"শুধু জীবন না। ওদের ওই পুরুষত্বটাই কেড়ে নিয়েছি আমি!" দাঁতে দাঁত কামড়ে বলল আফসানা।
"সবকিছু তো হলো মিস্টার রবি। এবার?"
রবির দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করলেন এসপি সাহেব। রবি বেশ কিছুক্ষণ ভেবে রাফি এবং আফসানার দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসি দিয়ে বলল,
"আমার কাছে অস্থির একটা পরিকল্পনা আছে।"
.
.
সারাদেশের সংবাদমাধ্যমে একটি খবর ঢালাও করে প্রচার হচ্ছে। শুধু তাই নয় ফেইসবুক, ইউটিউবসহ অন্যান্য সামাজিক মাধ্যমে প্রচুর আলোচনা আলোচনা হচ্ছে।'হারকিউলিস মারা গিয়েছে'!
.
.
"গতকাল রাতে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর একটি বিশেষ দলের সাথে রাজধানীর কেরানীগঞ্জে তুমুল গোলাগুলির ফলে দেশের নতুন বনে যাওয়া হিরো হারকিউলিস অগ্নিদগ্ধ হয়ে মারা যায়। আগুনে পোড়ার ফলে শরীরের কোন অংশ দৃশ্যমান ছিলো না। চেহারা থেকে হাত-পা সম্পূর্ণ অংশ পুড়ে কালো মাংস বেরিয়ে গিয়েছে। সকালে হারকিউলিসের লাশবাহী গাড়িতে সাধারণ জনগণের হামলা হয়। তারা হারকিউলিসের এই মৃত্যু মানতে পারে না। অনেককে দেখা যায় রাস্তায় গড়াগড়ি দিয়ে কান্নাকাটি করছে। শাহবাগের রাস্তাটি যেনো কান্নার মিছিলে পরিণত হয়। এভাবেই হারকিউলিস আমাদের থেকে বিদায় নেয়। তবে তিনি আমাদের দেখিয়েছেন ধর্ষকদের আসল স্থান। তিনি আমাদের শিখিয়েছেন কীভাবে ধর্ষকদের শাস্তি দিতে হয়। বাংলাদেশ সেনাবাহিনী জানায় হারকিউলিস যেই ঘরটিতে ছিলো, সেই ঘরের দরজায় একটি উক্তি লেখা ছিলো,
'যে পুরুষ নিজের পুরুষত্ব সামলাতে না পেরে ধর্ষণ নামক নোংরা খেলায় মেতে ওঠে, তার পুরুষাঙ্গ কেটে দাও। তার পুরুষত্ব ধ্বংস হলে বদলে যাবে সমাজ, থেমে যাবে ধর্ষণ।'
আমরা হারকিউলিসের দেওয়া এই শিক্ষা কতটা মানতে পারি সেটাই দেখার বিষয়। আসুন, সবাই একযোগে সমাজ থেকে ধর্ষণ নামক শব্দটি মুছে ফেলি। আর গড়ে তুলি আমাদের কাঙ্ক্ষিত সোনার বাংলা।'
- মেহেদী হাসান রাব্বি, দৈনিক ভোরের সংবাদ, কেরানীগঞ্জ, ঢাকা।
.
.
"হ্যালো, আফসানা।"
"হ্যাঁ বলো?"
"ভালোবাসি।"
"ওরে ছোকরা তুমি আমার থেকে তিন বছরের ছোট।"
"তবুও ভালোবাসি।"
"আমি ধর্ষিতা।"
"তবুও ভালোবাসি।"
"আমার পরিবার গরিব আর তোমার পরিবার ধনাঢ্য।"
"তবুও ভালোবাসি।"
"আমিও ভালবাসি রাফি!"
.
.
রবি এবং এসপি তরিকুল ইসলাম দুজনেই থানায় বসে চা খাচ্ছে। দুজনের চেহারাতে একটি স্বস্তির ছাপ ফুটে উঠছে।
"আসলে মিস্টার রবি, আপনার বুদ্ধির তুলনা হয় না। এই দেখুন, সবাই খুশি। আপনি, আমি, রাফি আফসানা, সকলেই খুশি।"
"আসলে আমি যখন দেখলাম আপনি আফসানার ব্যাপারে কঠিন কিছু বলছেন না, তখন আমি বুঝতে পেরেছি আপনি নিজেও চান আফসানা বেঁচে থাকুক।"
"কী আর করবো বলেন। এই দেশে প্রায় দুই লাখ পুলিশ আছে। আইনের প্রতি সবাইকেই শ্রদ্ধাশীল হতে হবে। আইনের প্রতি সবার শ্রদ্ধাবোধ জাগানোর জন্য হারকিউলিসদেরর এভাবেই থামিয়ে রাখা হয়। কেননা দেশের আইনের লঙ্ঘন করলেই শুরু হয় বিদ্রোহ। তবে আপনার বুদ্ধির তারিফ করতে হবে। আফসানাকে দিয়ে শেষ খুনটা করিয়ে সেই ধর্ষককেই হারকিউলিস বানিয়ে দিলেন। আপনার মাথায় প্রচুর বুদ্ধি।"
"সিগারেট খাবে খাবেন? শুনেছি থানায় বসে এসপির সাথে একসঙ্গে সিগারেট টানতে নাকি দারুন লাগে।"
"আমি অবশ্য এসব খাই না। তবে আজ না-হয় একটা খেলাম। মন্দ হবে না। চলুন আজকে আপনার জন্য নতুন একটি কেস পাওয়া গিয়েছে, মামু গোয়েন্দা।"
(সমাপ্ত)
This post has received a 17.11 % upvote from @boomerang.