ছোটগল্প "রক্তঝরা অভিশপ্ত রাত" - ০৩

in আমার বাংলা ব্লগ2 years ago

[ঐতিহাসিক সত্য ঘটনা অবলম্বনে নিচের গল্পটি রচনা করা হয়েছে । এর আগে একাধিক খ্যাতিমান লেখক এই রক্তজল করা সত্য ঘটনা অবলম্বন করে অনেক গুলি গল্প রচনা করে গিয়েছেন । তন্মধ্যে "সিংহ কবলিত যাত্রী ট্রেন", লেখক বীরু চট্টোপাধ্যায়, গল্পটির কিছু কিছু অংশ এখনো মনে আছে । খুব ছোটবেলায় শিশুসাথীর পূজাবার্ষিকীতে গল্পটি পড়েছিলুম।
তবে, আমার আজকের লেখাটি একেবারেই সত্য ঘটনা অবলম্বনে মৌলিক লেখা ]



কপিরাইট ফ্রী ইমেজ সোর্স : Pixabay


দ্বিতীয় পর্বের পর ...


গির মধ্যে বিশাল সিংহটি লাফিয়ে পড়া মাত্র তড়িৎবেগে তিনজনকে নিহত করে ফেললো । কামরার দু'প্রান্ত থেকে দু'জন শিকারী মুহূর্তমধ্যে রাইফেল চালিয়ে মেরে ফেললো সেটিকে ।

বিশাল সোনালী কেশর রক্তে মাখামাখি হয়ে ছিন্ন বিচ্ছিন্ন মানবদেহের ওপর চিরনিদ্রায় শায়িত হলো । কামরার যাত্রীসাধারণ আতঙ্কে নিমেষে পাথর হয়ে গেলো যেন ।

বগির ছাদ তো ভাঙা, এখন যদি একের পর এক সিংহেরা লাফিয়ে ঢুকে পড়ে, তাহলে ? তখন তো কামরার একটি প্রাণীও জীবিত থাকবে না । কামরার মধ্যে শিকারীরা দ্রুত একটি সংক্ষিপ্ত আলোচনা করে নিলো এ ব্যাপারে । মোট ছয় জন শিকারী পালাক্রমে মিনিট খানেক পর পর কামরার ভাঙা চালের ফাঁক দিয়ে শূন্যে গুলি করতে থাকলো । এই প্ল্যানে কাজ হলো । কোনো সিংহ আর এদিকপানে ঘেঁষলে না ।

এদিকে ধীরে ধীরে ভোর হয়ে এলো । অরুণরাগের কিরণছটায় উদ্ভাসিত অরণ্যের গাছগাছালি । পাখপাখালির ডানা ঝাপটানো আর কিচিরমিচির শোনা যেতে লাগলো । অবশেষে কালরাত্রি প্রভাত হলো ।

দিনের আলো ফোটা মাত্রই সিংহের দল পালিয়ে গেলো জঙ্গলের মধ্যে।

সিংহের দল পালানো মাত্রই রেলের গার্ডরা প্রতিটি কামরায় খোঁজ নিতে এলো । সিংহের হানায় পাঁচ জন নিহত এবং বেশ কয়েকজন আহত হয়েছে দেখা গেলো । আহতদের দ্রুত শুশ্রূষার ব্যবস্থা করে অবশিষ্ঠ যাত্রীদের সবাইকে খুব ভালো করে বুঝিয়ে দেওয়া হলো যে ইঞ্জিন লাইনের ওপর তুলতে না পারলে কোনোক্রমেই এই বিপদ থেকে উদ্ধার পাওয়ার আর আশা নেই ।

সবাই এ কথার সাথে নিজেদের সম্মতি জ্ঞাপন করলো । সবার আগে প্রাতরাশের ব্যবস্থা করা হলো । গতকাল রাত থেকে কারোর পেটেই কিচ্ছু পড়েনি । প্রাতরাশ সমাধা হতেই সবাই নেমে পড়লো ইঞ্জিন তোলার কাজে । এবার শুধু পুরুষেরা নয় সমর্থ মেয়েরাও পুরুষদের সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে ইঞ্জিন তোলার কাজ শুরু করলো ।

ঘন্টা চারেক অমানুষিক পরিশ্রমের ফলে ইঞ্চি ইঞ্চি করে ট্রেনের বিশাল ভারী ইঞ্জিনটাকে মাটির ওপর থেকে লাইনের দু'ইঞ্চি উপরে তোলা হলো । কাজ প্রায় শেষ । এবার শুধু দুলিয়ে লাইনের ওপর ঠিকভাবে ঠেলে বসিয়ে দেওয়া বাকি । সেটি করতে গিয়েই হলো চরম বিপত্তি । যেসব লোহার জয়েস্ট এর সাহায্যে ইঞ্জিনটি তোলা হচ্ছিলো সহসা একটি বিকট আওয়াজে সেগুলো ভেঙে গেলো ।

সঙ্গে সঙ্গে ধাতব শব্দ করতে করতে ইঞ্জিন ফের মাটিতে পড়ে গেলো । বেশ কিছুটা ওপর থেকে লাইনের একটা সাইডে সজোরে ধাক্কা দিয়ে ইঞ্জিনটা মাটিতে প্রোথিত হলো । আর এর ফলে সব চাইতে বড়ো বিপদটা হলো । লাইনের ধাক্কায় ইঞ্জিনের একটি আনসেল ভেঙে একেবারে দু'টুকরো হয়ে গেলো ।

আর কোনো উপায় নেই । নতুন আনসেল, ক্রেন, রেলের যন্ত্রাংশ আর ইঞ্জিনিয়ার ছাড়া আর কোনোভাবেই ট্রেন চালু হবে না ।

চরম হতাশা আর আতঙ্ক গ্রাস করলো প্রতিটা যাত্রীর মনে । আবার একটি কালরাত্রি সামনে । মৃত্যু ভয়ে বিবশ হয়ে গেলো সবাই । যতই হোক মানুষ তো, কিছুক্ষনের মধ্যেই আতঙ্ক ঝেড়ে ফেলে নিজেদের রক্ষা করার উপায় খুঁজতে ব্যস্ত হয়ে পড়লো সবাই । সিংহ আগুন ভয় পায় মারাত্মক । তাই পরিকল্পনার প্রথমভাগে ঠিক হলো পুরো ট্রেনের চারিপাশে কিছুটা তফাতে তফাতে এক একটা অগ্নিকুন্ড জ্বালানো থাকবে সারা রাত ধরে । সে জন্য চাই প্রচুর কাঠ । মুহূর্তমধ্যে যাত্রীদলের সবাই, ছেলে বুড়ো মেয়ে নির্বিশেষে লেগে গেলো জ্বালানি কাঠ সংগ্রহে ।

এবার, শিকারীদল আর রেলের গার্ডদের মধ্যে একটা আলোচনা হলো । ঠিক হলো শিকারী আর গার্ডরা আজ রাতে গ্ৰুপে গ্ৰুপে ভাগ হয়ে প্রতিটি কামরার দু'পশে অগ্নিকুন্ডের কাছে আর কামরার ছাদের উপরে প্রহরায় নিযুক্ত থাকবে । সিংহমেধ হবে আজকে রাতে ।

সব পরিকল্পনাই ঠিকঠাক ছিল । কিন্তু, সমস্যা দেখা দিলো অন্য জায়গায় । গতকাল রাতে সিংহের তান্ডবে ছ'টি কামরার মধ্যে দু'টি কামরা পরিত্যক্ত হলো । একটির চাল ভাঙা, অন্যটির দরজা ভাঙা । এই দুই কামরার যাত্রীরা থাকবে কোথায় ? যেটির দরজা ভাঙা সেটিতে কিছু যাত্রীদের ঢুকিয়ে দু'জন শিকারী ভাঙা দরজার কাছে প্রহরায় থাকলো । তারপরেও বেশ কিছু যাত্রীর কোনো কামরাতেই স্থান সংকুলান হলো না ।

এখন উপায় ? অবশেষে ঠিক হলো যে তাদেরকে ট্রেনের নিচে চাকার আড়ালে আত্মগোপন করে থাকতে হবে । আর এটাই ছিল সবচাইতে মারাত্মক একটি ভুল ।

সন্ধ্যের বেশ কিছুটা আগে থেকেই আগুন জ্বেলে দেওয়া হলো ট্রেনের চারিপাশে । প্রত্যেকটা যাত্রী কামরায় ঢুকে ভালো করে দরজা জানালা সব এঁটে দিলো । সব চেয়ে ভীত হয়ে পড়লো ট্রেনের চাকার নিচে যাদের লুকোতে বলা হয়েছিল তারা । শিকারীরা তাদের বুঝিয়ে বলাতেও ঠিকমতো আশ্বস্ত করা গেলো না । কিন্তু কিছু করারও নেই । তাই নিজেদের ভবিতব্য নিজেরাই বরণ করে নিলো তারা ।

সন্ধ্যের কিছুটা পর পরই অগ্নিকুন্ডের অনেকটা দূরে দূরে সিংহের দেখা মিললো । সার সার জ্বলন্ত সবুজাভ হলদে চোখ । ক্ষুধার্থ সে চোখের মারাত্মক চাহনি । হুম হাম করে ডাক ছাড়তে লাগলো তারা । কিন্তু, কোনোক্রমেই কাছে ঘেঁষল না । শিকারীদের রাইফেলের গুলি কমে যাওয়াতে অত দূরে খামোখা কেউ গুলি ছুঁড়লো না ।

রাত ক্রমে বেড়েই চলেছে । সেই সাথে সিংহের আনাগোনাও বৃদ্ধি পাচ্ছে । রাত দশটার পর থেকে ঘন ঘন রক্তজল করা হুঙ্কার ভেসে আসতে থাকলো । সর্বনাশ ! রাত বাড়ার সাথে সাথে ক্ষুধার্থ সিংহের মেজাজ শতগুনে বৃদ্ধি পেয়েছে । স্থানীয় যাত্রীরা এই গর্জন ভালো করেই চেনে । তারা প্রমাদ গুনলো ।

মধ্যরাতে অগ্নিকুন্ডের আগুন একটানা জ্বলার পরে হঠাৎই বেশ কিছুটা স্তিমিত হয়ে পড়লো । সিংহেরা যেন ওঁৎ পেতে এই সুযোগের অপেক্ষাতেই ছিল ।

[ক্রমশঃ]

Sort:  

Hi @rme,
my name is @ilnegro and I voted your post using steem-fanbase.com.

Come and visit Italy Community

 2 years ago 

দাদা আপনার গল্পটি পড়ে অতৃপ্তই থেকে গেলাম কথায়!! যেখানে বাঘের ভয় সেখানে সন্ধ্যা হয়। এই জঙ্গলে যতই তারা দ্রুত কাজ ছেড়ে চলে আসতে যাচ্ছে ততই তাদের জন্য বিপদ ঘনিয়ে আসছে। তবে আগুন দেখে বেশিরভাগ পরশুরা ভয় করে তাই তারা ট্রেনের আশেপাশে আগুনের কুন্ডলী জ্বালিয়ে রেখেছে যাত্রা যাতে সিংহ আসতে পারে। আপনি খুব সুন্দর ভাবে একজন খ্যাতিমান লেখক এর মত করে নিখুঁতভাবে গল্প গুলো লিখে থাকেন আপনার লেখা গল্প করতে খুবই ভালো লাগে কারণ আপনার লেখা গল্পের ভেতর এমন এক টুইস্ট পাওয়া যায় যা শুধুমাত্র একজন নামকরা লেখোকের বইতে পাওয়া যায়। এত সুন্দর একটি গল্প ধারাবাহিক ভাবে আমাদের মাঝে উপস্থাপন করে যাওয়ার জন্য আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ পরবর্তী পর্বের অপেক্ষায় রইলাম দাদা।

Thank You for sharing Your insights...

 2 years ago 

দাদা,এমন এমন জায়গায় গল্প শেষ করেন,আপসোস ছাড়া কিছুই করতে পারি না।একের পর একেক বিপদ।যাই হোক পরর্বতী পর্বে পড়ার অপেক্ষায় আছি।ধন্যবাদ

 2 years ago 

মনে হচ্ছে আমি যেন উপস্থিত থেকে স্বচক্ষে ঘটনাগুলো দেখছি। চমৎকার আপনার লেখার হাত। যতই পড়ছি আর ততই আগ্রহ বেড়ে যাচ্ছে। শিকার করার ক্ষেত্রে সিংহ যে চরম বুদ্ধিমত্তার পরিচয় দেয় মনে হচ্ছে সামনেই তা দেখতে পাব। দেখা যাক শেষ পর্যন্ত কি হয়।

 2 years ago 

দাদা কোথায় আছে যেখানে বাঘের ভয় সেখানে সন্ধ্যা হয়। কি দরকার ছিল শেষ মুহূর্তে এসে লোহার জয়েস্ট গুলো ভেঙ্গে যাওয়ার। আরতো মাত্র কিছুক্ষণ সময় ইন্জিনটা লাইনের মধ্যে বসানো গেলেই সম্ভবত অনেকগুলো প্রাণ রক্ষা পেত। এত বড় বিপদের মাঝেও তারা আগুন জ্বালিয়ে সিংহের আক্রমণ থেকে বাঁচার পদ্ধতি অবলম্বন করতে পেরেছে। এ বিষয়টা আমাদের সকলের জন্য শিক্ষণীয় বিপদের মাঝেও ধৈর্য নিয়ে মাথা ঠান্ডা করে সেটা মোকাবেলা করতে হয়। আসলে দাদা আমার কাছেও মনে হচ্ছে ট্রেনের চাকার নিচে লুকিয়ে থাকা সিদ্ধান্তটা সবচেয়ে বড় বোকামি ছিল। কারণ আগুন তো সারারাত ধরে রাখা সম্ভব নয়। আবার এমন জায়গায় শেষ করলেন দাদা আত্মার অতৃপ্তি থেকেই গেল।

Thank You for sharing Your insights...

 2 years ago 

ক্রমশ ভয় কাজ করতে লাগলো যতক্ষণ এই গল্পটা পড়লাম।জীবনের আরো একটি রাত এই ভয়ংকর যায়গায় কাটাতে হবে ভেবেই আমার গা শিউরে উঠল।

মধ্যরাতে অগ্নিকুন্ডের আগুন একটানা জ্বলার পরে হঠাৎই বেশ কিছুটা স্তিমিত হয়ে পড়লো । সিংহেরা যেন ওঁৎ পেতে এই সুযোগের অপেক্ষাতেই ছিল।

এই লাইনগুলো পড়ে আমি তো আরও ভয় পেলাম,কি যে হবে সামনের সময়ে।তবে এই ভয়ংকর মূহুর্তগুলো পড়ার এবং শেষ পরিণতি জানার জন্য অপেক্ষায় রইলাম।

 2 years ago 

শুনে গা টা শিওরে উঠল। আগুন নিভে যাওয়ার উপক্রম সিংহ রাও রয়েছে চরম ক্ষুদার্ত এবার কী হবে। এমন একটা জায়গাই গল্পটা শেষ করেছেন যে আগামীকাল পযর্ন্ত অপেক্ষা করতে মন চাইছে না। একেই বুঝি বলে বিপদের উপর বিপদ। ইঞ্জিন তুলতে গিয়ে একেবারে বিকল হয়ে গেল।

এবার শুধু পুরুষেরা নয় সমর্থ মেয়েরাও পুরুষদের সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে ইঞ্জিন তোলার কাজ শুরু করলো ।

পৃথিবীর সব মহান কাজেই ছেলেদের পাশাপাশি সাহায্য করেছে মেয়েরা। তারা ছাড়া কোনো মহৎ কাজ সম্পন্ন হয়নি। কিন্তু এক্ষেত্রে কোনো লাভ হলো না।।

Thank You for sharing...

 2 years ago 

দাদা এইভাবে শেষ না করলে হয় না?।এমন জায়গায় শেষ হয় যে পরবর্তী পর্ব না পড়া পর্যন্ত শান্তি লাগে না।
আজ রাতে মনে হচ্ছে চাকার নীচে লুকানো লোকগুলোর আর রক্ষা হবে না। চাপাচাপি করে কামরায় একটা জায়গা দিতে পারলেন না।😭😭

Coin Marketplace

STEEM 0.26
TRX 0.11
JST 0.033
BTC 63994.25
ETH 3062.19
USDT 1.00
SBD 3.94