চেম্বার কথন: একজন হাউজমেইডের (Housemaid) গল্প যিনি তার চাকরি হারানোর দ্বারপ্রান্তে!

in আমার বাংলা ব্লগ2 months ago
হ্যালো! কেমন আছেন সবাই। আশা করি সবাই ভাল আছেন। "চেম্বার কথন" সিরিজের ৩ নং পোস্ট নিয়ে আপনাদের সামনে হাজির হলাম। এখানে আমি আমার চেম্বারে পরামর্শ দেয়া কোন একটা রুগীর রোগ সম্পর্কিত একটা ছোট গল্প বলি। গল্পের শেষে এর আলোকে শিক্ষণীয় বিষয়গুলো পয়েন্ট আকারে উল্ল্যেখ করি। চলুন শুরু করা যাক।

একজন হাউজমেইডের (Housemaid) গল্প যিনি তার চাকরি হারানোর দ্বারপ্রান্তে!

ওমানে যে বহিরাগতরা (expatriates) কর্মক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশী সাফার করে, বাংলাদেশী হাউজমেইডরা তাদের মধ্যে অন্যতম। বাড়িওয়ালী (Sponsor) ভাল না হলে তো কথায় নেই। নিজের শারিরীক অসুস্থ্যতার জন্যে এই সাফারিং বেড়ে যায় অনেকক্ষেত্রে। কখনো কখনো ফিরে যাওয়া লাগে দেশে!! এরকমই একজনের গল্প আজকে!

আইডি কার্ড অনুযায়ী উনার বয়স ৪৩ বছর। বিগত ৬ মাস ধরে উনি বিভিন্ন শারিরীক সমস্যায় ভুগছেন। আমার কাছে প্রথম এসেছিলেন মার্চ মাসের ১৯ তারিখ। অনেকগুলো কমপ্লেইনস। কোমর ব্যথা। বাম পাশে বেশী এবং ব্যথাটা বাম পায়ের দিকে নামে (radiating pain to the left lower limb) । সাথে কিছু অবশ অবশ ভাব আছে (numbness)। পিঠের উপরের দিকেও ব্যথা আছে যেটা ঘাড়ের দিকে ছড়িয়ে পড়ে। ঘাড়ের ব্যথার জন্যে অলরেডি এক্সরেও করিয়েছেন একবার আরেকটা হাসপাতালে, আমার কাছে আসার ২ মাস আগে। এক্সরে তে নাকি কোন সমস্যা ওঠে নাই। তার মানে, ঐ ব্যথা ছিল মাংস কিংবা নার্ভের ব্যথা, হাড়ের কারণে না। ডাক্তারের পরামর্শ মোতাবেক ফিজিওথেরাপীও (Physiotherapy) নিয়েছেন। পিঠে ব্যথার পাশাপাশি শরীরে জ্বালাপোড়াও আছে।

মহিলার সাথে এসেছেন তার বাড়িওয়ালী, যদিও চিকিৎসা খরচ রুগীর নিজের। বাড়িওয়ালী গাড়িতে করে নিয়ে এসেছেন। রুগীর সাথে কথা শেষ হবার পর স্পন্সর জিজ্ঞেস করলেন যে ঐ হাউজমেইড কাজ করতে পারবে কিন না। যদি ডাক্তার বলে যে উনি কাজ করতে পারবে না, তাহলে দেশে পাঠিয়ে দিবেন। এদিকে রুগী কান্নাকাটি করছে যে উনি এখানেই থেকে কাজ করতে চান। অনেক টাকা খরচ করে বিদেশ এসেছেন। লোনের বোঝা মাথার উপর!!

বল এখন ডাক্তার এর কোর্টে!

কোন প্রকার পরীক্ষা-নিরিক্ষা না করেই শুধু লক্ষণশুনেই বলে দেয়া যায় না যে উনি "কাজের জন্যে ফিট না"। উপরন্তু একজন জি.পি. ডাক্তারের এরকম সার্টিফিকেট দেয়া ঠিকও না। ফাইনাল ডিসিশান অবশ্য আসতে হবে একজন স্পেশালিস্ট এর কাছ থেকে।

আমি স্পন্সরকে বললাম যে কোমরের এক্সরে করে দেখতে হবে। তারপর আমি ওষুধ দিতে পারব। ওষুধে কাজ না হলে তখন অন্য চিন্তা কইরেন। উনারা রাজী হলেন। কোমরের এক্সরেতে কিছু হাড়ক্ষয়ের নমুনা আসল। আমি যে অনুযায়ী ওষুধ দিলাম। রুগীটা যেন সুস্থ্য হয়ে যায় এবং বিদেশ খাটতে পারে, যে জন্যে আমার জ্ঞানে যা যা দেয়ার মত দিলাম। একটা ইনজেকশানও দিলাম!

প্রথম ভিজিটের ২ সপ্তাহমত পরে আবার উনারা এসে হাজির। আমার দেয়া ওষুধ খেয়ে প্রথমদিকে কিছুটা উন্নতি হয়েছিল (সম্ভবত ইনজেকশানের কেরামতি) কিন্তু ওষুধ শেষে লক্ষণগুলো আবার ফিরে আসছে। তখনো অতিমাত্রায় শুরু হয় নাই! আমি হতাশ! রুগীকেও হতাশ মনে হলে। একপর্যায়ে একটা দীর্ঘশ্বাসের সাথে স্বগোক্তি করলেন, "আমার মনে হয় বিদেশ খাটা কপালে লেখা নাই"

প্রথম থেকে চুপচাপ বসে বাসা স্পন্সর অবশেষে মুখ খুললেন। যা ভাবছিলাম সেটা বললেন। "এই হাউজমেইড কি কাজ করতে পারবে?"! আমার ঘাড়ে বন্দুক রেখে হাউজমেডকে বিদায় করতে চাচ্ছেন। এই অসুস্থ্য কাজের লোকে কে কেইবা রাখতে চায়! টাকা দিয়ে কি আর অসুস্থ্য লোক পুষবে কেউ!!

আমি বলে দিলাম, "আমি রকম কোন সার্টিফিকেট দিতে পারব না। স্পেশালিস্ট দেখান। আর কাজের লোক রাখা না রাখা আপনার সিদ্ধান্ত। কাজ করতে না পারলে পাঠিয়ে দেয়ার এখতিয়ার আপনাদের অবশ্যই আছে। আমার ওষুধে কিছুটা কাজ হয়েছিল। আবার কিছু ওষুধ বদলিয়ে দিচ্ছি, সাথে ইনজেকশান! অপেক্ষা করে দেখতে পারেন কাজ হয় কি না"! ইনজেকশান এবং ওষুধ নিয়ে তারা বিদায় হল।

ঐ হাউজমেইড এর ফেইট (Fate) জানা হয় নাই!



এই গল্পের আলোচ্য রোগ (কোমর ব্যথা) সম্পর্কিত কিছু উল্লেখযোগ্য তথ্যঃ

  • হঠাৎ কোমর ব্যথার সবচেয়ে কমন কারণ হচ্ছে মেকানিক্যাল ব্যাক পেইন (Mechanical low back pain)। ভারি কোন জিনিস তুলতে গিয়ে, ভারি কাজ করতে গিয়ে কিংবা সামনের দিকে নুইয়ে কাজ করতে গিয়ে এই ব্যথা শুরু হয়।
  • এটাকে সেলফ লিমিটিং ব্যাক পেইন বলা হয়। অর্থাৎ নিজে নিজেই ঠিক হয়ে যায়। দেখা গেছে যে শতকরা ৯০ ভাগ লোকের ক্ষেত্রে এ ধরণের কোমর ব্যথা ৬ সপ্তাহের ভিতর ঠিক হয়ে যায়! তবে ভারি জিনিস তোলা বা কোমর ঝুকিয়ে কাজ করা বন্ধ রাখতে হবে।
  • এই মেকানিক্যাল কোমর ব্যথা রেস্টে থাকলে কমে, কাজ করলে বাড়ে। রেস্ট মানে এই না যে সারাদিন বিছানায় শুয়ে থাকতে হবে। ভারি কাজ গুলো এড়িয়ে চলতে হবে। নিজের স্বাভাবিক চলাফেরা হাটাচলা চালাতে হবে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে লাইট এক্সসারসাইজ করা উপকারী হিসাবে বেবেচিত হয়।

ওকে। আজকে এ পর্যন্তই। আশা করি কিছু নতুন তথ্য পেয়েছেন আমার পোস্ট থেকে। কোন পরামর্শ বা প্রশ্ন থাকলে কমেন্ট এর মাধ্যমে জানাবেন। ভাল থাকুন।

আল্লাহ হাফেজ

ডা. হাফিজ
ওমান



চেম্বার কথন সিরিজের পূর্ববর্তী পোস্টঃ

ফরনিয়ার গ্যাংগ্রীনে আক্রান্ত এক রুগীর গল্প

পেশাব এবং তলপেটের ব্যথা নিয়ে আসা এক রুগীর গল্প



আমি ডা. হাফিজ। ঢাকার একটা মেডিকেল থেকে ডাক্তারী পাশ করেছি। ২০১৪ সাল থেকেই দেশের বাইরে আছি। শুরুতে ২ দুই বছর ছিলাম মালদ্বীপে। তারপর থেকে ওমানে আছি গত ৭ বছর ধরে। এখানে একটা পলিক্লিনিক এ জি.পি. ডাক্তার হিসাবে কর্মরত আছি বর্তমানে।
My Discord ID: hafiz34#3722

Posted using SteemPro

Sort:  
 2 months ago 

আপনার এই সিরিজটি আমার কাছে ভীষণ ভালো লাগে, কারন বাস্তব অভিজ্ঞতার সাথে সাথে অনের রোগ সম্পর্কে ক্লিয়ার ধারনা পাওয়া যায় এবং সেই সাথে সাথে দারুন কিছু পরামর্শ। অনেক ধন্যবাদ কোমর ব্যথার বিষয়টি সুন্দরভাবে উপস্থাপন করার জন্য।

 2 months ago 

শুনে ভাল লাগলো যে এই পোস্ট আপনার ভাল লেগেছে। চেস্টা থাকবে এরকম পোস্ট চালিয়ে যাওয়া।

Coin Marketplace

STEEM 0.18
TRX 0.12
JST 0.027
BTC 65181.06
ETH 3405.23
USDT 1.00
SBD 2.48