সুমনা চক্রবর্তী

in #bangla2 years ago

1_q7AdA7-wTCSA885xJlZt_w.png

সুমনা চক্রবর্তী

মেঘের দেশে (পর্ব- ২) // সুমনা চক্রবর্তী

তামাংজির বাড়িটা প্রথমে ভালো লাগেনি আবিরার। পাশাপাশি ঘরগুলো দেখলে যেন ঘুমিয়ে আছে বলে মনে হচ্ছিল। আবিরা যখন নিজের ঘরটা পেল, তখন মনটা এক্কেবারে ভালো হয়ে গেল। যতক্ষণ আলো ছিল ততক্ষণ সে ঘরের বাইরেই ঘোরাঘুরি করছিল। চারপাশ যেই অন্ধকার হতে শুরু করল ঘরের দরজা বন্ধ করে কাঁচের জানলা দিয়ে সামনের সিকিমের পাহাড় চোখে দেখা ছাড়া আর কোনও কাজ রইল না। এখানে কোনও ঘরে টেলিভিশন নেই। মোবাইলও খুব কাজ করে না। দিনের বেলা যদিও দু একবার বাড়ির সাথে যোগাযোগ করতে পেরেছে, এখন সেটাও করা যাচ্ছে না।

আবিরা তার ঘরে একা। তার ঘরের ওপরে আরও দুটো ঘর আছে। ঐ ঘর থেকে টুকরো কথা ভেসে আসছে। আবিরা নিজের মনেই হাসল। তার আর কথা কিসের? বাড়িতে বাবা সারাক্ষন কাজ নিয়ে মেতে। মেয়ের মূল্যহীন কথা শোনার সময় তার নেই। এই যে আবিরা যখন ইচ্ছে বেরিয়ে পড়ে, এতেও বাবার খুব একটা প্রশ্ন থাকে না। ভাবলেশ হীন মুখে বলে দেয়, “যাচ্ছ যাও, দরকার মনে হলে ফোন করবে। পাকামো করবে না”।আবিরার এসব শুনে হাসি পায়। যে মানুষটা একবারও জানতে চায় না যে আদৌ মেয়েটা একা যেতে চায় কি না, তার সাহায্য কতখানি ফলপ্রসূ হবে কে জানে। আর তাছাড়া মস্ত বড় ব্যবসা ছেড়ে আবিরার কাছে আসতে বাবার বয়েই গেছে। আবিরার কথা তাই তারার সাথে, বৃষ্টির জলের ফোঁটার সাথে, উঁচু পাহাড়ের সাথে, সূর্যোদয়ের সাথে, মেঘের সাথে আর অন্ধকারের সাথে। এই যেমন এখন অন্ধকারের কাছে সে জানতে চায়, কাল সকালে মেঘের আনাগোনা কতদূর হবে। যদি মেঘ এসেও থাকে, তবে তা থাকবে কতক্ষণ। মেঘের সাথে তার একপ্রস্থ লুকোচুরি খেলা আজ হয়ে গেছে। একেক সময়ে খারাপ লাগলেও পরে মনে হয়, এটাই তো স্বাভাবিক। জীবনে যেমন ওঠাপড়া থাকে, চলার পথেও সেরকমই থাকবে। যত সহজে তা মেনে নেওয়া যায় তত ভালো। ছবি উঠছে না বলে মন খারাপ করে তো লাভ নেই। কোনও এক সময় সুযোগ আসবে, তখনই চেষ্টা করবে সে।

এই ঘরের বিছানা বা আসবাব কোনও কিছুই আরামদায়ক নয় আবার অপরিষ্কারও নয়। একজন মানুষের রাত্রিবাসের জন্য ঠিক যা যা দরকার তার সবটাই আছে। অবশ্য সকলের ঠিক এগুলোই দরকার হবে কি না আবিরা জানে না। তামাংজি কিন্তু এতকিছু ভেবে ঘরগুলো করেনি। আর করেনি বলেই এখানে মেলার মতো লোকজনও আসে না। যারা সত্যিই প্রকৃতিকে আপন করে নিতে পারে, তারাই এই ম্যাপে না থাকা জায়গায় আসে। আবিরার বাড়িতে মন টেকে না। ম্যানেজমেন্টের কোর্স করে একটা চাকরিও পেয়েছিল সে। দিব্যি সময় কেটে যেত। অন্তত কথা বলার সঙ্গী তো জুটছিল। সে চাকরিও বাধ্য হয়ে ছাড়তে হল তাকে। এতে নাকি তার বাবার মানসম্মানের প্রশ্ন এসে যাচ্ছিল। বাবার কথায় চাকরি যদি করতেই হয় তো বাড়ির অফিসে করতে হবে। আবিরা একটু প্রতিবাদ করেছিল। কিন্তু পরে সে ভেবে দেখেছে যে, বাড়ির অফিসে সে নিরুপদ্রবে কাজটা করতে পারবে। আর বাবার কথামতো উপযুক্ত পারিশ্রমিকও পাবে। তাই আর কথা না বাড়িয়ে সুবর্ণ সুযোগটা নিয়ে নিয়েছিল। কিন্তু সেখানেও যে জাল বিছানো থাকবে কে জানত? অফিস ম্যানেজার সোমনাথ তার বন্ধু। পরে কথায় কথায় সে জানতে পারে, বাবার ব্যস্ত মনে মেয়ের জন্য ভাবনাটা ঢুকিয়েছিল এই সোমনাথ। আবিরা তাই বন্ধু সোমনাথের কাছে ঋণী। অয়ন মিত্রর মতো সবকিছু তুচ্ছতাচ্ছিল্য করা লোকটা অবশেষে নিজের মেয়েকে বিশ্বাস করছে। আবিরা চোখ বন্ধ করে দেওয়ালে হেলান দিল। তার মুখ দিয়ে বেরিয়ে এলো গানের দু কলি- “এই করেছো ভালো, নিঠুর হে, এই করেছ ভালো। এমনি করে হৃদয়ে মোর তীব্র দহন জ্বালো”।

ঘরের টিমটিমে আলোটা বন্ধ হয়ে গেলেও আবিরার চোখে কিছুই ধরা পড়ল না। শান্ত পাহাড়ি এলাকা যেন আবিরার করুণ সুরে নিজেকে জাগিয়ে তুলতে চাইল। ওপরের ঘরের দুমদাম শব্দও কখন যেন থেমে গেছে।

Sort:  

You've got a free upvote from witness fuli.
Peace & Love!