অপ্রত্যাশিত সন্ধ্যা
সন্ধ্যা নামছে ধীরে ধীরে। কলকাতার ব্যস্ত রাস্তায় ট্রাফিক জ্যামের মধ্যে আটকে পড়া একটি ট্যাক্সির পেছনের সীটে বসে আছে দেবাঞ্জন। বাইরে বৃষ্টি শুরু হয়েছে, হালকা থেকে ক্রমশ জোরালো হচ্ছে। ট্যাক্সি ড্রাইভার রেডিওতে পুরনো বাংলা গান চালিয়েছে - হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের কণ্ঠে "এই পথ যদি না শেষ হয়।"
দেবাঞ্জন জানলার কাঁচে জমা বৃষ্টির ফোঁটা দেখছিল। আজ অফিস থেকে বেরিয়ে সোজা বাড়ি ফিরতে চেয়েছিল, কিন্তু এই বৃষ্টি আর ট্রাফিক তার পথে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। সে মোবাইলে দেখল সন্ধ্যা সাড়ে ছ'টা বেজে গেছে।
হঠাৎ তার চোখ পড়ল রাস্তার পাশের একটি ছোট কফি শপের দিকে। দোকানের সামনে একটি মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে, মাথায় ছাতা। কিছুটা চেনা চেনা লাগছে। দেবাঞ্জন ভাল করে তাকাল। হ্যাঁ, এ তো শ্রেয়সী! কলেজের পুরনো বন্ধু, প্রায় আট বছর পর।
"ভাই, এখানে থামাবেন?" দেবাঞ্জন ড্রাইভারকে বলল।
ট্যাক্সি থেকে নেমে সে দ্রুত কফি শপের দিকে এগোল। "শ্রেয়সী!"
মেয়েটি ঘুরে তাকাল। প্রথমে চিনতে পারল না, তারপর চোখ বড় বড় করে বলল, "দেব? তুমি?"
"হ্যাঁ! কী অবিশ্বাস্য! এতদিন পর!"
দুজনেই হেসে উঠল। শ্রেয়সী বলল, "আমি কফি খেতে ঢুকছিলাম। চলো না, একসাথে খাই।"
ভেতরে ঢুকে তারা একটা কোণের টেবিলে বসল। জানলার বাইরে বৃষ্টি পড়ছে, ভেতরে হালকা আলো আর কফির গন্ধ।
"তুমি এখন কী করছ?" দেবাঞ্জন জিজ্ঞেস করল।
"আমি এখন একটা আর্কিটেকচার ফার্মে কাজ করি। তুমি?"
"আমি IT সেক্টরে। সল্টলেকে অফিস।"
কফি এল। দুজনে পুরনো দিনের গল্প করতে লাগল। কলেজের দিনের নানা স্মৃতি, ক্যান্টিনে আড্ডা, ক্লাস বাংক করা, প্রজেক্টের দৌড়ঝাঁপ - সব কিছু যেন সেদিনের ঘটনা।
"মনে আছে সেই দিনটা? যখন আমরা গোটা ক্লাস মিলে পিকনিক করতে গিয়েছিলাম?" শ্রেয়সী জিজ্ঞেস করল।
"হ্যাঁ! সেদিন তুমি রান্না করেছিলে, খিচুড়ি। জীবনে এত টেস্টি খিচুড়ি আর খাইনি।"
"আরে, তুমি তো সেদিন তিনবার রিপিট করেছিলে!"
দুজনে হেসে উঠল। বাইরে তখনও বৃষ্টি পড়ছে। কফি শপের ভেতর গরম কফির কাপে চুমুক দিতে দিতে তারা আরও অনেক গল্প করল। শ্রেয়সী জানাল সে এখন বিবাহিত, দুই বছর আগে বিয়ে হয়েছে। স্বামী একজন ডাক্তার, মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে প্র্যাকটিস করেন।
দেবাঞ্জন বলল সে এখনও অবিবাহিত। বাবা-মা প্রায়ই চাপ দেন বিয়ের জন্য, কিন্তু সে এখনও নিজের ক্যারিয়ারে মনোযোগ দিতে চায়।
"জানো দেব," শ্রেয়সী বলল, "কলেজে যখন ছিলাম, মনে হত জীবনটা কতই না সহজ। যে যার পথে এগিয়ে যাব, সব কিছু পরিকল্পনা মত হবে। কিন্তু বাস্তবে কত কিছুই যে অন্যরকম হয়ে যায়।"
দেবাঞ্জন চুপ করে রইল কিছুক্ষণ। তারপর বলল, "হ্যাঁ। কিন্তু মাঝে মাঝে এমন অপ্রত্যাশিত মুহূর্তও তো আসে। আজকের মত।"
শ্রেয়সী মৃদু হেসে বলল, "সত্যি। আচ্ছা দেব, তুমি কি এখনও গিটার বাজাও? কলেজে তো তুমি ব্যান্ডে ছিলে।"
"হ্যাঁ, মাঝে মাঝে। তবে আগের মত সময় পাই না। তুমি? তোমার তো পেইন্টিং খুব ভাল ছিল।"
"আমিও মাঝে মাঝে আঁকি। অফিসের কাজের পর যখন সময় পাই। কিছুদিন আগে একটা আর্ট গ্যালারিতে আমার দুটো ছবি প্রदর্শিত হয়েছিল।"
"সত্যি? দারুণ তো! আমাকে জানাওনি কেন?"
"কী করে জানাব? তোমার নাম্বারই তো ছিল না।"
দুজনেই আবার হেসে উঠল। এর মধ্যে বাইরে বৃষ্টি থেমে গেছে। সন্ধ্যা গভীর হয়েছে। কফি শপের বাইরে রাস্তায় ভিজে মাটি থেকে ভেসে আসছে বৃষ্টির গন্ধ।
"চলো না একটু হেঁটে আসি?" শ্রেয়সী প্রস্তাব করল।
দুজনে বেরিয়ে পড়ল। রাস্তায় লোকজন কমে গেছে। দোকানপাট বন্ধ হতে শুরু করেছে। তারা হাঁটতে হাঁটতে পার্কের কাছে চলে এল।
"এখানে কত বিকেলে আড্ডা দিয়েছি," দেবাঞ্জন বলল। "মনে আছে? পরীক্ষার আগের দিন এখানে বসে গ্রুপ স্টাডি করতাম।"
"হ্যাঁ। আর তুমি সবসময় বলতে পরীক্ষার আগের দিন পড়ে কিছু হবে না। কিন্তু নিজে সবচেয়ে বেশি নাম্বার পেতে।"
"সেটা কিন্তু ভাগ্য!"
"ভাগ্য না তোমার মাথা! তুমি যে কত পরিশ্রম করতে সেটা আমরা সবাই জানতাম।"
একটু থেমে শ্রেয়সী বলল, "জানো দেব, মাঝে মাঝে ভাবি। আমাদের জীবন কত দ্রুত বদলে যায়। কলেজের পর সবাই নিজের নিজের পথে চলে গেলাম। কারও সাথে যোগাযোগ রইল না। অথচ একসময় মনে হত এই বন্ধুত্ব, এই সম্পর্কগুলো চিরকাল থাকবে।"
দেবাঞ্জন বলল, "কিন্তু দেখো, আজ এতদিন পর হঠাৎ করে দেখা। মনে হচ্ছে না যেন কোন দূরত্ব তৈরি হয়েছে। একই রকম গল্প করছি, হাসছি।"
"হ্যাঁ। কিছু সম্পর্ক হয়তো এমনই। সময়ের সাথে দূরে সরে যায়, কিন্তু মনের মধ্যে একই রকম থাকে।"
রাত বাড়ছিল। শ্রেয়সী বলল তার এবার বাড়ি ফেরা দরকার। স্বামী অপেক্ষা করছেন।
"চলো, তোমাকে একটা ট্যাক্সি ধরিয়ে দিই," দেবাঞ্জন বলল।
ট্যাক্সি পাওয়া গেল। যাওয়ার আগে তারা মোবাইল নাম্বার এক্সচেঞ্জ করল।
"এবার আর যোগাযোগ হারাবে না তো?" শ্রেয়সী জিজ্ঞেস করল।
"না। তবে তুমিও মাঝে মাঝে ফোন করবে।"
"নিশ্চয়ই। আচ্ছা শোনো, আগামী শনিবার আমাদের বাসায় ডিনারে এসো। রাজেশের সাথেও আলাপ হবে।"
"নিশ্চয়ই যাব।"
ট্যাক্সি চলে গেল। দেবাঞ্জন দাঁড়িয়ে রইল কিছুক্ষণ। আকাশে তারা ফুটেছে। বৃষ্টি ধোয়া রাস্তায় স্ট্রিট লাইটের আলো প্রতিফলিত হচ্ছে। সে ভাবল, জীবন সত্যিই অদ্ভুত। কখন কোন মোড়ে কী অপেক্ষা করে থাকে কে জানে। হয়তো তাই প্রতিটা মুহূর্তই বিশেষ।
সে নিজের জন্য একটা ট্যাক্সি ধরল। বাড়ি ফেরার পথে গাড়ির জানলা দিয়ে বাইরের দৃশ্য দেখতে দেখতে ভাবল, আজকের এই সন্ধ্যাটা কত অপ্রত্যাশিত ছিল। একটা সাধারণ কর্মব্যস্ত দিনের শেষে এমন একটা অসাধারণ সন্ধ্যা। পুরনো বন্ধুর সাথে দেখা, পুরনো স্মৃতি, নতুন করে যোগাযোগের সূত্রপাত।
বাড়ি পৌঁছে সে মোবাইলে দেখল শ্রেয়সীর মেসেজ: "Thank you for making my day special! See you on Saturday!"
দেবাঞ্জন হাসল। জীবনের সব