শীতের রাত মানেই আলাদা এক অনুভূতি। গ্রামের খেলার মাঠ তখন দিনের কোলাহল ছেড়ে নিস্তব্ধ, চারপাশে কুয়াশার চাদর, আকাশে ঝকঝকে তারা। এমনই এক শীতের রাতে বন্ধুদের সাথে কাটানো একটি স্মৃতিময় অভিজ্ঞতা আজও মনে পড়লে বুকের ভেতর অদ্ভুত উষ্ণতা ছড়িয়ে পড়ে।

সেদিন সন্ধ্যার পরই আমরা কয়েকজন বন্ধু ঠিক করলাম মাঠে যাবো। বাড়ি বাড়ি থেকে লুকিয়ে লুকিয়ে জোগাড় করলাম শুকনো কাঠ, খড় আর কিছু ডালপালা। কারো হাতে টর্চ, কারো হাতে দেশলাই। মাঠের মাঝখানে পৌঁছে আগুন জ্বালানো হলো। প্রথমে ছোট্ট শিখা, তারপর ধীরে ধীরে বড় হয়ে উঠল আগুন। শীতের কাঁপুনি যেন মুহূর্তেই দূরে সরে গেল। আগুনের আলোয় বন্ধুদের মুখগুলো স্পষ্ট হয়ে উঠল, হাসি আর গল্পে ভরে গেল চারপাশ।তারপর এল সেই কাঙ্ক্ষিত মুহূর্ত মুরগি পুড়িয়ে খাওয়ার প্রস্তুতি। আগেই জোগাড় করা মুরগিটা পরিষ্কার করে লবণ-মরিচ মাখানো হলো। কেউ কাঠিতে গাঁথল, কেউ আগুন ঠিকঠাক রাখল। আগুনের উপর মুরগি ঘুরতে ঘুরতে পুড়ছিল, আর চারদিকে ছড়িয়ে পড়ছিল অসাধারণ এক ঘ্রাণ। ক্ষুধায় আমাদের সবার চোখে মুখে ছিল অপেক্ষার ছাপ। কেউ কেউ আগুনের পাশে বসে গল্প করছিল, কেউ শৈশবের দুষ্টুমি নিয়ে হাসাহাসি করছিল।

মাঝে মাঝে কুয়াশার ভেতর দিয়ে ঠান্ডা বাতাস এসে আগুনের শিখা নাচিয়ে দিচ্ছিল। আমরা সবাই আগুনের চারপাশে আরও কাছে সরে বসতাম। সেই আগুন শুধু আমাদের শরীর নয়, মনকেও উষ্ণ করছিল। বন্ধুত্বের বন্ধন যেন আরও শক্ত হচ্ছিল প্রতিটি মুহূর্তে।অবশেষে মুরগি পুড়িয়ে তৈরি হলো। আগুন থেকে নামিয়ে ভাগ করে নিলাম সবাই। হাত দিয়ে গরম গরম মাংস খাওয়ার সেই স্বাদ আজও মুখে লেগে আছে। কোনো প্লেট, কোনো চামচ ছিল না, ছিল শুধু হাসি, আনন্দ আর বন্ধুত্ব। সেই সাধারণ খাবারই সেদিন রাজকীয় ভোজে পরিণত হয়েছিল।

খাওয়া শেষে আমরা আগুনের পাশে বসে অনেকক্ষণ গল্প করেছিলাম। কেউ ভবিষ্যতের স্বপ্নের কথা বলল, কেউ পুরোনো দিনের কথা মনে করিয়ে দিল। সময় যে কখন এতটা এগিয়ে গেল, টেরই পাইনি। গভীর রাতে যখন বাড়ি ফেরার সময় হলো, আগুন নিভিয়ে আমরা ধীরে ধীরে মাঠ ছেড়ে বেরিয়ে পড়লাম।আজ অনেক বছর পেরিয়ে গেছে। জীবন বদলেছে, সবাই ব্যস্ত হয়ে পড়েছে নিজের কাজে। তবুও শীতের কোনো এক রাতে আগুনের আঁচ পেলেই মনে পড়ে যায় সেই মাঠ, সেই আগুন, আর বন্ধুদের সাথে মুরগি পুড়িয়ে খাওয়ার সেই অমূল্য স্মৃতি। এই স্মৃতিই বুঝিয়ে দেয়,সুখ আসলে খুব সাধারণ, শুধু মন খুলে উপভোগ করতে জানতে হয়।