ছোট বেলার একটা সেরা খেলা: মারবেল খেলা
ছোটবেলার স্মৃতিতে ভেসে ওঠে সেই রোদঝলমলে দুপুরগুলো, যখন আমরা গ্রামের মাটিতে বসে মারবেল খেলার আয়োজনে মেতে উঠতাম। এই খেলা আমাদের ছোটবেলার সেরা বিনোদনগুলোর একটি ছিল, যা আমাদের কল্পনার জগতে নিয়ে যেতো। গ্রামে বসবাসকারী সবার কাছেই মারবেল খেলা পরিচিত একটি নাম, যা শুধু বিনোদনই নয়, বন্ধুদের সাথে বন্ধনেরও প্রতীক ছিল।
প্রতিদিন স্কুল শেষে বা ছুটির দিনে আমরা সবাই মিলে মাঠের এক কোণে জড়ো হতাম। আমাদের কাছে থাকা টাকার অঙ্ক খুব সামান্য হলেও, সেই টাকায় পাওয়া মারবেলগুলোর মূল্য আমাদের কাছে ছিল অপরিসীম। এক টাকার মারবেল পেতাম পাঁচটি। হাতে যখন সেই রঙিন মারবেলগুলো ধরা পড়তো, মনে হতো যেন আমরা অমূল্য কোনো ধন পেয়েছি।
খেলা শুরু করার আগে আমরা সবাই মিলে মাঠে ছোট একটি গর্ত তৈরি করতাম। সেই গর্ত ছিল আমাদের খেলার কেন্দ্রবিন্দু। এরপর সবাই একে একে মারবেল ছুটানোর জন্য প্রস্তুত হতাম। খেলার নিয়ম ছিল সবার মারবেলগুলো গর্তের নির্দিষ্ট দূরত্বে ছুটানো, এবং এরপর প্রথমে যার মারবেল নিদিষ্ট দাগের বাইরে থাকবে, সেই আগে খেলবে। সবাইকে নিয়ে সাদা-নীল-মেরুন রঙের মারবেলগুলো গর্তের আশেপাশে ছড়িয়ে দিতাম। তারপর শুরু হতো মূল খেলা।
প্রথম খেলোয়াড় হিসেবে আমি মারবেলগুলো সজোরে ছুঁড়ে দিতাম, যাতে সেগুলো ছিটকে গর্ত থেকে দূরে চলে যায়। যখন মারবেলগুলো ছিটকে পড়ত, তখন আমাদের লক্ষ্য হতো নির্দিষ্ট একটি মারবেল ছুঁড়তে। কিন্তু যদি কোনো খেলোয়াড় সেই মারবেলে আঘাত করতে না পারতো, তবে তাকে খেলায় হারতে হতো এবং পরের খেলোয়াড় সুযোগ পেত। মারবেলের রঙিন গোলকগুলোকে লক্ষ্য করে আমরা বারবার চেষ্টা করতাম সঠিকভাবে আঘাত করার। সেই মুহূর্তগুলোতে আমাদের সবার মাঝে উত্তেজনা বাড়তো, আর প্রতিযোগিতার আগুন যেনো আরো প্রজ্জ্বলিত হতো।
কিন্তু খেলা শুধু খেলার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকতো না। মাঝে মাঝে আমরা এতটাই তন্ময় হয়ে যেতাম যে, কেউ মারবেল নিয়ে প্রতারণা করলেই আমাদের মধ্যে ঝগড়া বেঁধে যেত। একে অপরের উপর রাগ ঝাড়তাম, কখনো কখনো মারামারিও হতো। সেই মারামারি ছিলো খেলারই একটা অংশ। তবে যতই ঝগড়া লাগুক না কেন, আমাদের বন্ধুত্বের বাঁধন ছিল অটুট। একটু ঝগড়ার পরই আমরা সবাই আবার মিলে যেতাম, একসাথে খেলতাম, হাসতাম আর খেলা শেষে সবাইকে নিয়ে ফিরে যেতাম গ্রামের রাস্তায়।
মারবেল খেলা আমাদের জন্য ছিল শৈশবের এক অমূল্য সম্পদ। সেই ছোট ছোট মারবেলগুলো যেন আমাদের শৈশবের সব রঙ আর আনন্দকে নিজের মধ্যে ধারণ করে রাখতো। খেলার মাঠে বসে আমরা সময়ের কোনো খেয়াল রাখতাম না, শুধু সেই মুহূর্তগুলোতেই ডুবে থাকতাম। দিন শেষে যখন আমরা ক্লান্ত হয়ে বাড়ি ফিরতাম, তখন আমাদের মন ভরে থাকতো সেই খেলার আনন্দে। সেই স্মৃতিগুলো আজও হৃদয়ের এক কোণে সযত্নে লালিত রয়েছে।
এখনো যখন কোনো মেলায় বা দোকানে রঙিন মারবেল দেখি, তখন শৈশবের সেই দিনগুলো মনে পড়ে। মনে পড়ে সেই বন্ধুত্ব, সেই খেলার মজা, আর ছোটবেলার সেই নির্ভেজাল আনন্দ। সময়ের পরিক্রমায় আমরা বড় হয়েছি, জীবনের বিভিন্ন ধাপে পা রেখেছি, কিন্তু সেই মারবেল খেলার স্মৃতিগুলো কখনোই ম্লান হবে না। কারণ ছোটবেলার সেই সেরা খেলাটি ছিল আমাদের জীবনের প্রথম পাঠশালা, যেখানে শিখেছি বন্ধুত্ব, আনন্দ, প্রতিযোগিতা আর পরস্পরের সাথে এক হয়ে থাকার গুরুত্ব।