শৈশবের স্মৃতি- পুতুলের বিয়ে নিয়ে যত স্মৃতি
আসসালামু আলাইকুম
*
কেমন আছেন আমার প্রিয় ও সহযাত্রী সকল ভাই ও বোনেরা। আশা করি সবাই অনেক ভালো আছেন।আজ আবারও হাজির হয়ে গেলাম আপনাদের সবার অতি নিকটে। ফেলে আশা অনেক স্মৃতির মাঝ থেকে কিছু স্মৃতি নিয়ে। আমাদের চলার পথে জীবনে সুখ দুঃখ কতো স্মৃতি জড়িয়ে আছে।সেই শৈশব থেকে শুরু করে মৃতুর আগ পর্যন্ত স্মৃতিগুলো যেন চোখে ও মনের মনি কোঠায় ভেসে বেড়ায়। আর তার মধ্যে জীবনে এমন অনেক ঘটনা থাকে যা কখনও ভোলা যায় না।

প্রতিটি মানুষের জীবনে শৈশব হলো এক অনন্য সময়, এক সত্যিকারের স্বর্ণযুগ। আমরা যত বড়ই হই না কেন, আমাদের শৈশবকে কখনও ভুলতে পারি না। জীবনের প্রতিটি পর্যায়ে, প্রতিটি সুখ-দুঃখের মুহূর্তে শৈশব যেন ফিরে আসে মধুর স্মৃতির পরশ নিয়ে। কখনও মনে হয়, যদি আবার সেই দিনগুলোয় ফিরে যাওয়া যেত, যেখানে ছিল নিঃস্বার্থ হাসি, খেলাধুলা আর নির্ভেজাল আনন্দে ভরা দিনরাত্রি। কিন্তু সময়ের টানে, জীবনের বাস্তবতায় আমাদের সবাইকেই ফিরে আসতে হয় বর্তমানে। তবুও হৃদয়ের এক কোণে শৈশবের আলো, সেই নির্ভার সময়গুলোর স্মৃতি আজও জ্বলজ্বল করে। আজ আমি আমার জীবনের এমনই এক স্মৃতি ভাগ করে নিতে চাই, যেখানে ভয়, সাহস আর শিশুসুলভ কৌতূহল মিলেমিশে এক অদ্ভুত অভিজ্ঞতা তৈরি করেছিল।
মাঝে মাঝে ছেলেবেলার কথা খুব মনে পড়ে। সেই সময়টা ছিল একেবারে অন্যরকম। এখনকার মতো মোবাইল ফোন, টেলিভিশন, কিংবা ব্যস্ত জীবন তখন ছিল না। ছিল শুধু হাসিখুশি, খেলাধুলা আর নির্ভেজাল আনন্দে ভরা সময়। আমি তখন খুব খেলায় পাগল ছিলাম। বন্ধুদের সাথে সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত খেলাধুলা করতাম। কত রকমের খেলা যে খেলতাম—কখনও লুকোচুরি, কখনও বউচি, আবার কখনও পুতুল খেলা। মা রাগ করতেন, বকাও দিতেন, কিন্তু আমি যেন থামতেই জানতাম না। খেলাধুলাই ছিল আমার সবচেয়ে বড় ভালো লাগা।
তবে আমার ছেলেবেলার সবচেয়ে প্রিয় খেলা ছিল পুতুল খেলা। মানে, পুতুলের বিয়ে দেওয়া। আজও মনে আছে, কী আনন্দ, কী উত্তেজনা নিয়ে আমি সেই পুতুল খেলা আয়োজন করতাম। আমার সব সময় এক জন ছেলে পুতুল থাকত। আমি সেই পুতুলকে বিয়ে করিয়ে আনতাম। পুতুলের বিয়েতে আমি এমনভাবে আয়োজন করতাম যেন সত্যিকারের কোনো মানুষের বিয়ে হচ্ছে। বরযাত্রী আসত, কনে সাজানো থাকত, অতিথিরাও আসত, গান বাজনা হতো, এমনকি হলুদ অনুষ্ঠানও আয়োজন করতাম। মনে হতো, আমি যেন এক বড় অনুষ্ঠান পরিচালনা করছি।
আমার পুতুল ছিল অনেকগুলো। একেকটা পুতুলের একেকটা নাম, একেকটা গল্প। কেউ ছিল ‘রিমি’, কেউ ‘টুনি’, আবার কেউ ‘মিষ্টি’। আমি ওদের যত্ন করতাম নিজের মতো করে। সেই পুতুলগুলো রাখার জন্য আমার একটি ছোট বাক্স ছিল। যেন এক গুপ্তধনের বাক্স। প্রতিদিন স্কুল থেকে ফিরে আমি বাক্স খুলে পুতুলগুলো দেখতাম, ওদের জামা বদলাতাম, চুল আঁচড়াতাম, আর নতুন নতুন গল্প ভাবতাম। কখনও কখনও একা একাই পুতুলদের সঙ্গে কথা বলতাম। আমার মনে হতো, ওরা আমার সত্যিকারের বন্ধু।
পুতুলের বিয়ে দেওয়ার জন্য আমি আগে থেকেই টাকা জমাতাম। স্কুলে টিফিনের জন্য যে টাকা পেতাম, তা থেকে কিছু অংশ বাঁচিয়ে রাখতাম। ধীরে ধীরে সেই টাকায় বিয়ের আয়োজন করতাম। তখনকার দিনে এই আয়োজনটাই ছিল আমার সবচেয়ে বড় পরিকল্পনা। হলুদ অনুষ্ঠানে বন্ধুদের ডাকতাম, কেউ কেউ পুতুল সাজাতে সাহায্য করত, কেউ গান গাইত, কেউ বরযাত্রী সেজে অভিনয় করত। আমাদের হাসি, চিৎকার, আনন্দে চারপাশ ভরে যেত। সেই হাসির শব্দ যেন আজও কানে বাজে।
আমার মা মাঝে মাঝে এসে বলতেন, “এই সব পুতুল পুতুল খেলা কবে ছাড়বি?” কিন্তু মা-ও শেষে হেসে ফেলতেন, কারণ তিনি জানতেন, আমি এই খেলায় কতটা মজা পাই। কখনও মা নিজেই পুতুলের জন্য পুরনো কাপড় দিয়ে জামা বানিয়ে দিতেন। সেই জামা পরে পুতুলগুলো আরও সুন্দর লাগত। তখন আমি গর্ব করে বন্ধুদের দেখাতাম—দেখো, আমার পুতুলের পোশাক কত সুন্দর!
একবার মনে আছে, আমি পুতুলের বিয়ের জন্য এমন আয়োজন করেছিলাম যে আশেপাশার সবাই জানতে পেরেছিল। আমি নিজের হাতে আমন্ত্রণ পত্র বানিয়ে দিয়েছিলাম বন্ধুদের। ছোট কাগজে রঙিন কলমে লিখেছিলাম, “আমার পুতুলের বিয়ে, সবাই আসবে।” সেই দিন বিকেলে আমাদের উঠানে ছোট করে অনুষ্ঠান বসেছিল। একটা চাদর বিছিয়ে তার উপর পুতুলদের বসানো হয়েছিল। পাশে ফুল, খেলনা বাসন, আর মোমবাতির আলো। সবাই মিলে তালি দিচ্ছিল, হাসছিল, গল্প করছিল। সেই দৃশ্য আজও আমার চোখে ভাসে।
আমাদের তখনকার জীবনে এমন খেলাগুলোই ছিল আনন্দের উৎস। আমরা জানতাম না আধুনিক খেলনা বা বড় আয়োজন কীভাবে হয়। কিন্তু আমাদের কল্পনা এত শক্তিশালী ছিল যে, পুতুল খেলার মাধ্যমেই আমরা তৈরি করতাম নিজেদের এক রঙিন জগৎ। সেখানে আমি ছিলাম পরিচালক, সাজসজ্জাকারী, গায়ক, এমনকি অতিথিও। আমার মন ভরে যেত। মনে হতো, এই ছোট্ট আয়োজনেই যেন পুরো পৃথিবী আনন্দে ভরে গেছে।
বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে পড়াশোনার চাপ বেড়ে গেল, খেলার সময় কমে গেল। ধীরে ধীরে পুতুল খেলাটা হারিয়ে গেল আমার জীবন থেকে। সেই বাক্সে থাকা পুতুলগুলো হয়তো একসময় হারিয়ে গেছে, অথবা পুরনো হয়ে ভেঙে গেছে। কিন্তু তাদের স্মৃতি কখনও মুছে যায়নি। মাঝে মাঝে আজও চোখ বন্ধ করলে মনে হয়, আমি আবার সেই ছোট্ট উঠানে ফিরে গেছি, যেখানে পুতুলের বিয়ে হচ্ছে, আমি লাল ওড়না পরে বরযাত্রীকে স্বাগত জানাচ্ছি, বন্ধুরা হাসছে, মোমবাতির আলোয় মুখগুলো ঝলমল করছে।
এই স্মৃতিগুলো আমার জীবনের সবচেয়ে মধুর অংশ। এখন যখন বড়দের দুনিয়ায় কাজ, দায়িত্ব আর ব্যস্ততায় ডুবে আছি, তখন মনে হয়—কত সহজ ছিল সেই সময়! তখন আনন্দ পেতে কোনো কিছুর দরকার হতো না, শুধু একটা পুতুল আর একটু কল্পনাই যথেষ্ট ছিল। আমরা এখন নানা বিলাসে ঘেরা, কিন্তু সেই নির্ভেজাল আনন্দ খুঁজে পাওয়া মুশকিল।
কখনও ভাবি, যদি আবার সেই ছেলেবেলায় ফেরা যেত! যদি আবার পুতুলদের সাজিয়ে বসাতে পারতাম, আবার হলুদ অনুষ্ঠানে গান গাইতে পারতাম, আবার সেই ছোট বন্ধুদের নিয়ে হাসতে পারতাম। কিন্তু সময় তো আর ফিরে আসে না। শুধু স্মৃতিগুলোই থেকে যায়—মনের এক গভীর কোণে, যেন এক রঙিন স্বপ্নের মতো।
আজও যখন শিশুদের পুতুল খেলতে দেখি, আমার মনে পড়ে আমার সেই দিনগুলো। ওদের হাসির মধ্যে নিজের ছেলেবেলাকে দেখতে পাই। মনে হয়, সময় বদলে গেছে, কিন্তু শৈশবের আনন্দ চিরকাল একই রকম থাকে। যত দিন মানুষ বাঁচবে, তত দিন এই ছোট ছোট খেলা, এই পুতুল বিয়ে, এই কল্পনার আনন্দ বেঁচে থাকবে। কারণ এই ছোট ছোট স্মৃতির ভেতরেই লুকিয়ে আছে জীবনের সবচেয়ে বড় সুখ, সবচেয়ে সুন্দর ভালো লাগা।
এইভাবেই আমার ছেলেবেলার পুতুল খেলা আজও আমার মনে এক অবিচ্ছেদ্য জায়গা দখল করে আছে। সময়ের সঙ্গে অনেক কিছু বদলে গেছে, আমি বড় হয়েছি, জীবন বদলেছে, কিন্তু সেই পুতুল খেলার হাসি, সেই আনন্দ, সেই ছোট ছোট প্রস্তুতির উত্তেজনা আজও অমলিন। মনে হয়, জীবনের সবচেয়ে সুন্দর সময় ছিল সেই—যখন আমি ছিলাম এক ছোট্ট মেয়ে, যার পৃথিবী ছিল পুতুলে ভরা, আর যার সবচেয়ে বড় স্বপ্ন ছিল পুতুলের বিয়ে দেওয়া।
কেমন লাগলো আপনাদের কাছে আমার আজকের শেয়ার করা ভ্রমণ পোস্ট। আশা করবো আপনাদের কাছে বেশ ভালো লাগবে। আপনাদের মতামতের অপেক্ষায় রইলাম।
আমার পরিচিতি
আমি মাহফুজা আক্তার নীলা । আমার ইউজার নাম @mahfuzanila। আমি একজন বাংলাদেশী ইউজার। আমি স্টিমিট প্লাটফর্মে যোগদান করি ২০২২ সালের মার্চ মাসে। আমার বাংলা ব্লগ কমিউনিটিতে যোগদান করে আমি অরেনেক বিষয় শিখেছি। আগামীতে আরও ভালো কিছু শেখার ইচ্ছে আছে। আমি পছন্দ করি ভ্রমন করতে, ছবি আঁকতে, বিভিন্ন ধরনের মজার মাজার গল্পের বই পড়তে, ফটোগ্রাফি করতে, ডাই প্রজেক্ট বানাতে ও আর্ট করতে। এছাড়াও আমি বেশী পছন্দ করি মজার রেসিপি করতে। মন খারাপ থাকলে গান শুনি। তবে সব কিছুর পাশাপাশি আমি ঘুমাতে কিন্তু একটু বেশীই পছন্দ করি।


