রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের অজানা কথা
অসত্য থেকে আমাকে সত্যতে নিয়ে যাও, অন্ধকার পেরিয়ে জ্যোতিতে, মৃত্যু পার হয়ে অমৃতলোকে উত্তীর্ণ করো।’ তিনি আজীবন এই প্রার্থনা করেছেন।
বলেছেন সেই কঠিন অধ্যাবসায়ের কথা। বলেছেন, ‘রোজ শেষ রাত্রে জেগে সূর্যোদয়ের আগে পর্যন্ত নিজের মনকে আমি স্নান করাই। ...
শেষ রাত্রে আমার নিজের কাছ থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নেবার কাজ চলতে থাকে। সেই সময়টা খুব ভালো সময়। বাইরের কোনো কোলাহল থাকে না,
নিজেকে সহজেই খুঁজে পাওয়া যায়।’
ইউরোপ সর্বত্র গোটা বিশ্বে কবি রাজার মতো সম্মান পাচ্ছেন। কবির অভিজ্ঞান ‘গীতাঞ্জলি শুধুই যদি কবিতা হতো, তাহলে জনসাধারনের মনে এমন করে স্থান পেতুম না,
কারণ কয়জনই বা কবিতা বোঝে? এই বড়ো জায়গায় মনকে পৌঁছে দিতে উপনিষদ আমাকে সাহায্য করেছে। যুদ্ধের পর সমস্ত ইউরোপ মনের একটা আশ্রয় পেতে চাচ্ছে,
তাই এরা আমাকে এতো ভালবাসে।’
উপনিষদ তাঁর জীবনকে এমনই প্রভাবিত করেছে যা অন্য কারোর মধ্যে দেখা যায় নি। মৃত্যুর কয়েকদিন আগে একান্ত প্রিয়জনকে লিখেছেন, ‘যদি দ্বিধা থাকে,
তবে সেদিন আমার তপস্যার দিন আসবে, উপনিষদ হবে আমার সখা। তাঁর সঙ্গে আমার নিরাসক্ত সম্বন্ধ প্রত্যহ নিবিড় হয়ে আসছে।’
বলেছেন, “অসতো মা সদগময়’। এর চেয়ে বড়ো প্রার্থনা বোধহয় পৃথিবীতে কেউ উচ্চারন করেনি। তাই প্রতিদিন নিজেকে বলি তুমি সত্য হও,
পরিপূর্ণ সত্যের মধ্যে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করো। কখনো কোনো কারনে হটাৎ আত্মবিস্মৃত হলে পরে লজ্জিত হই কেন? কারণ আমার সত্য- আমিটিকে সে আবৃত করে দেয়,
অথচ আমার সারাজীবনের সাধনা ও আকাঙ্ক্ষা যে আমি প্রতিদিন তাকে নির্মল করে তুলবো। ‘অবিরাবীর্মএবি’, নইলে আমার মধ্যে তার প্রকাশ বাধাগ্রস্ত হবে।”
উপনিষদে এতো আত্মস্থ হয়েছিলেন বলেই হয়তো শেষের দিনগুলোতে হাসি ঠাট্টায় প্রিয়জনদের সঙ্গে মশগুল হতে পারতেন। এই বিশ্বে আনন্দ যতখানি সম্ভব আহরণ করে নেওয়া,
এই ছিল তাঁর প্রচেষ্টা। আর ছিল বাঁচবার অন্তরলীন আহ্বান।
নইলে শেষের সেই দিন হয়ত আর শান্তিনিকেতন থেকে কলকাতায় আসতে চাইতেন না। ডাক্তাররা বা প্রিয়জনেরা নিশ্চয় তাঁকে বুঝিয়েছিলেন,
তিনি রোগমুক্ত হবেন ... হবেন ... হবেন ... অপারেশনের সাহায্যে।
তাই কলকাতায় আসা।কে জানত সেটাই শান্তিনিকেতন থেকে শেষ যাত্রা। শান্তিনিকেতনের মাটিতেই যে তাঁর শুয়ে থাকার ইচ্ছে ছিল।
সেখানেই ছিল তাঁর ... প্রানের আরাম, মনের আনন্দ, আত্মার শান্তি ... !
শেষ জুলাইয়ে (২৭ তারিখ) একটা কবিতা লিখলেন, মনটা বেজায় খুশি। ডাক্তাররা তাঁকে দেখে কিন্তু খুশি নন। সব ভালো, আর কোন দুশ্চিন্তা নেই।
কবির সে কি দুঃখ।
কেউ বুঝি বললেন, দুঃখের কি আছে? এতে তো আনন্দ হবার কথা!
কবি বললেন, তুমি কিছুটি বোঝ না, রোগী আছে, ডাক্তার আছে, রোগ নেই, ওরা চিকিৎসা করবে কার?এতে ওঁদের মন খারাপ হয় না?
সকলে হেসে অস্থির।
অস্ত্রোপচারের পরের দিন। জোড়াসাঁকোয় যন্ত্রণায় অবসন্ন কবির শরীর। সকলে গম্ভীর। কি হয়, কি হয়! যেন সেই চরম মুহূর্তের প্রতীক্ষা চলছে।
কবি চোখ খুলতেই দেখতে পেলেন একটি বিষাদ ভরা মুখ তাঁকে নিরীক্ষণ করছে। তাঁর দিকে বড়ো বড়ো চোখ করে এমন মুখ ভঙ্গি করলেন যে সে মুখে বিষাদ উধাও।
.হাসি ফুটে উঠলো। এই তো, তা না গম্ভীর মুখ করে এসে দাঁড়ালেন! এতো গম্ভীর কেন? এবার একটু হাসো!
কবির কথায় বিষণ্ণ সে মুখে তখন হাসি ফুটে উঠলো, চোখে জল।
এতো যন্ত্রণার মধ্যেও কবি হাসছেন। সকলে অবাক। নির্মলকুমারী মহালনবিশ তাঁকে দেখেছেন একেবারে পাশে থেকো। তিনি বলছেন, চলে গেছে পুত্র, পুত্রসম আরও অনেকে।
একমাত্র দৌহিত্র তাঁরও মৃত্যু বিদেশে। টেলিগ্রামে খবর এসেছে, খড়দহ থেকে রথীন্দ্রনাথ ও প্রতিমাদেবীকে ডেকে এনে ওঁদের উপস্থিতিতে কবিকে সে খবর জানানো হয়।
শুনে কিছুক্ষণ স্তব্ধ থাকলেন, দু ফোঁটা জল বুঝি গড়িয়ে পড়ল চোখের।
কি অসাধারণ ধৈর্যের সঙ্গে সেই সংবাদ গ্রহন করলেন। আছে মৃত্যু, আছে দুঃখ ... তিনি লিখেছেন, ‘খুব কষ্ট হয় তা জানি, তবু একথাও অস্বীকার করলে চলবে না যে---
মৃত্যু না থাকলে জীবনের কোনো মুল্যই থাকে না, অনেক সময় আমরা চেষ্টা করে আর খুব ঘটা করে শোকটাকে জাগিয়ে রাখি, তা না হলে যেন যাকে হারিয়েছি
তাঁর প্রতি কর্তব্যের ত্রুটি হল বলে নিজেকে অপরাধী মনে হয়। কিন্তু আমার মতে সেইটেই অপরাধ, কারণ এটা মিথ্যে।’ মিথ্যে! মিথ্যে! মিথ্যে!
রবীন্দ্রনাথ ডুবে গিয়েছেন লেখায়। শেষ সপ্তক, পুনশ্চ লিখেছেন নিতুর অসুখ ও মৃত্যুর গভীর বেদনা নিয়ে। একমাত্র পুত্র হারা মা- মীরা। তাঁকে সাত্বনা দিয়েছেন আপন পুত্রশোকের
কথা উল্লেখ করে।
লিখেছেন, ‘শমী যে রাত্রে গেলো তাঁর পরের রাত্রে রেলে আসতে আসতে দেখলুম জ্যোস্নায় আকাশ ভেসে যাচ্ছে, কোথাও কিছু কম পরেছে তাঁর লক্ষ্মণ নেই।
মন বলল কম পড়েনি সমস্তর মধ্যেই সব রয়ে গেছে, আমিও তারি মধ্যে।’
কিন্তু ৭ আগস্ট তিনি চলে গেলেন। ২৪ সে আগস্ট, ১৯৪১। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সেনেট হলে নিখিল ভারত মহিলা সমিতি আয়োজিত রবিহারা সভায় নির্মলকুমারী বলছেন,
‘প্রিয়জনের মৃত্যু বেদনা কি রকম শান্তচিত্তে গ্রহন করতে হয় তাও যেমন দেখেছি, নিজের মৃত্যু যন্ত্রণা কি রকম ধৈর্যের সঙ্গে বহন করতে হয় তাও দেখলাম।’ ----“অসতো মা সদগময়!”
ওঁ শান্তি! ওঁ শান্তি! ওঁ শান্তি!