মানসিক নির্যাতন; একটি সামাজিক ব্যাধির নাম
আরও পড়ালেখা করে কি হবে? বিয়ের পরে চাকরি করতে চাও কেন? স্বামী চাকরির অনুমতি দিয়েছে তো? আমার মা তো গৃহিণী তাহলে তোমার হতে সমস্যা কোথায়? তুমি কি বিয়ের পরেও চাকরি করবে? সন্ধার পরেও তোমার বাইরে থাকতে হয়? তোমাকে নাইট ডিউটি করতে হয়? শহরের বাইরেও যেতে হয় তোমার অফিস থেকে? দেশের বাইরে একা একটা মেয়ে? উচ্চশিক্ষা নিতে দেশের বাইরে যেতে চাচ্ছ এটা কি করে সম্ভব? বিয়ের পর পড়ালেখা করিয়েছি কিন্তু চাকরি কেন করতে চাচ্ছ? অফিসে তোমার ডিপার্টমেন্টে তুমি একা একটা মেয়ে? বাচ্চা রেখে কাজ করাকে কেন এত ইম্পর্টেন্স দিচ্ছ? স্টাডিট্যুরে যেতে হবে কেন? গ্রুপস্টাডিতে কেন যেতে হবে?
কিছু বিষধর সামাজিক মনোবৃত্তি আমরা কম বেশি সবাই লালন করে বড় হই যা আমাদের অজান্তে আমাদের উপরেই চড়াও হয়। যার একটি হলো, অন্যের পরিবারের ঝামেলাতে আমার গিয়ে কাজ নেই, এই ধরের মনোভাব। তাই আমাদের অধিকাংশই পারিবারিক নির্যাতনকে স্বাভাবিক ভাবে নিয়েই বেড়ে উঠি।
পারিবারিক নির্যাতন বলতে আমরা মুলত শারীরিক নির্যাতনকেই বুঝি। আমাদের আজকের সুশীল এবং উন্নয়নশীল সামাজিক ব্যবস্থাতে অধিকাংশ মানুষই এই ধরনের নির্যাতনের কট্টর সরব বিরোধী। কিন্তু শারীরিক নির্যাতনের মতো মানসিক নির্যাতনও একটি গর্হীত সামাজিক অপরাধ।
খুবই দুঃখজনক সত্যি হলো আজকের সামাজিক ব্যবস্থাতে মানসিক নির্যাতনের মাত্রা শারীরিক নির্যাতন তুলনায় বেশি। আপনারা বেশিরভাগই হয়তো এর সাথে একমত হবেন না। তার মূল কারন হচ্ছে কোন ধরনের আচরনগুলো মানসিক নির্যাতনের মধ্যে পড়ে তাঁর সম্পর্কেই আমাদের ধারনা স্পষ্ট নয়। তাই এই লেখাতে এই ব্যপারে কিছুটা স্পষ্টতা আনার চেষ্টা থাকবে কি ধরনের ব্যবহার মানসিক নির্যাতনের মধ্যে পড়ে।
• কটুক্তি ও বিব্রত করাঃ
আমাদের সমাজের একটি প্রচলিত কথা হলো, স্বামী স্ত্রীর মধ্যে ঝগড়া হতেই পারে। কিন্তু এটা যখন নিয়মে দাঁড়িয়ে যায় সেটা কখনই স্বাভাবিক না। নিয়মিত, আপনাকে উঁচু স্বরে বকাবকি করা, গালিগালাজ করা, এমনসব কথা বারবার বলা যাতে আপনি উচ্চ স্বরে কথা বলতে বাধ্য হন। আর এইসব আচরন যদি আপনার সন্তান বা বাইরের লোকের সামনে করা হয় তবে ব্যপারটা হয়ে যায় আরও ভয়াবহ। সারাক্ষন তটস্থ থাকতে হয় যেন অপরপক্ষ উত্তেজিত না হয়ে যায়। শুধু উত্তেজনা নয় কেউকেউ আবার এটাও খেয়াল রাখতে হয় তার কোনও আচরন, অভ্যাস, পোষাক বা পছন্দ নিয়ে যেন আবার সবার সামনে ঠাট্টা তামাশা না শুরু হয় যায়। আর দুঃখজনক হলো এই বেপারটি করা হয় স্রেফ মজা নেয়ার উদ্দেশ্যে, এই আচরণটি যে কারো পাহাড়সম কষ্টের কারন হতে পারে তা হয়তো তাদের চিন্তাতেই আসে না।
• সন্দেহ প্রবনতাঃ
আমার শাশুরী ভীষণ সুন্দরী একজন মহিলা। তাঁর মুখে শুনেছিলাম অল্প বয়েসে টোকিও শহরে থাকাকালীন তাঁরা প্রায় সব বাঙ্গালী অনুষ্ঠানে অংশ নিতেন। কিন্তু তিনি একাকী এক কোনে বসেই এই দেশীয় উৎসবের সময়টুকু কাটাতেন। কারন আমার শশুর উনার অন্য কারো সাথে হেঁসে কথা বলা পছন্দ করতেন না। কারন স্বরুপ চিরাচরিত ভাবে যা বলা হয় তাই তিনি বলতেন, ‘তোমাকে আমি এতো ভালবাসি যে তুমি অন্য কারো সাথে হেঁসে কথা বললে আমার কষ্ট হয়’। কিন্তু আমার দৃষ্টিতে সন্দেহ প্রবণতা একটি মানসিক ব্যাধি ছাড়া আর কিছুই নয়। আমাদের সমাজে ছেলেদেরকে সন্দেহ করলে তাদেরকে এইব্যপারে গা করতে একদমই দেখা যায় না কারন এটি অধিকাংশ ক্ষত্রেই ক্ষনজন্মা, কিন্তু মেয়েদের ক্ষেত্রে এটি একটি মানসিক ক্যান্সারের চেয়ে কম কিছু নয়। বিশেষত যে সমাজে সাংসারিক বিফলতার দায় একমাত্র নারীর উপরেই বর্তায়।
• বিবাহোত্তর শিক্ষা ও কর্মজীবনঃ
কিছু সাধারন প্রশ্ন সারি বলছি তাহলেই বুঝতে পারবেন পরিস্থিতি ঠিক কতোটা জটিলতাপূর্ন। আরও পড়ালেখা করে কি হবে? বিয়ের পরে চাকরি করতে চাও কেন? স্বামী চাকরির অনুমতি দিয়েছে তো? আমার মা তো গৃহিণী তাহলে তোমার হতে সমস্যা কোথায়? তুমি কি বিয়ের পরেও চাকরি করবে? সন্ধার পরেও তোমার বাইরে থাকতে হয়? তোমাকে নাইট ডিউটি করতে হয়? শহরের বাইরেও যেতে হয় তোমার অফিস থেকে? দেশের বাইরে একা একটা মেয়ে? উচ্চশিক্ষা নিতে দেশের বাইরে যেতে চাচ্ছ এটা কি করে সম্ভব? বিয়ের পর পড়ালেখা করিয়েছি কিন্তু চাকরি কেন করতে চাচ্ছ? অফিসে তোমার ডিপার্টমেন্টে তুমি একা একটা মেয়ে? বাচ্চা রেখে কাজ করাকে কেন এত ইম্পর্টেন্স দিচ্ছ? স্টাডিট্যুরে যেতে হবে কেন? গ্রুপস্টাডিতে কেন যেতে হবে?
শুধু আর্থিক সচ্ছলতাই একটা মেয়ের চাকরি করার একমাত্র কারন নয়। নিজের শিক্ষার জোরে স্বনির্ভরতা অর্জন যেকোনো মানুষকেই আত্মিক তৃপ্তি দেয়। তাই শিক্ষার্জন ও কাজ করতে বাধা দেয়াও মানসিক নির্যাতনের মধ্যে পড়ে।
• অহেতুক দোষারোপঃ
যেকোন মানুষকে ধরাশায়ী করার সবচেয়ে বড় কৌশল হল তার নামে মিথ্যা অপপ্রচার কিংবা সামনাসামনি তাকে মিথ্যুক প্রমান করা বা করার চেষ্টা করা। প্রতিবাদ কতক্ষন সম্ভব? মিথ্যা যারা বলে তারা মানুষের মানসিক শক্তি ভেঙ্গে দেয়ার মতো মিথ্যা বলে ফেলতে পারে অনায়াসেই। হয়তো কোনও পরিস্থিতিতে বলে ফেলবে ‘এই তোমার বাবা-মা এর শিক্ষা’ অথবা ‘এই ব্যপারে কি করে তুমি কথা বলতে পারো, তুমি তো ভাল মানুষ নও’। আমি এইধরনের মানুষকে এমন সব জঘন্য কথাও বলতে শুনেছি যা তারা পরে বেমালুম অস্বীকার করে যায় বরং বাইরের মানুষের সামনে সুশীল মানুষের অভিনয় করে যায়। কিন্তু ব্যাপারটি যার সাথে ঘরে তিনি কিন্তু ভেতরে ভেতরে ভাঙ্গতে থাকেন, শেষ হয়ে যেতে থাকেন।
• একাকীত্বঃ
একজন মানুষের জীবনে একাকীত্ব সৃষ্টি করে মানসিক নির্যাতন করাটা বোধ করি সবচেয়ে সহজ। আপনজনের সাথে কথা বলা বা যোগযোগ করতে না দেয়াটা একা করে দেয়ার সবচেয়ে প্রচলিত ধরন। দেশের বাইরে নিয়ে গেলে তো একা করে দেয়ার ব্যপারটি সবচেয়ে সহজ হয়ে যায়। কষ্ট ভাগ করার জন্য না থাকে বন্ধু না থাকে আপনজন। হয়ে যায় আরও একটি অধিকারের অবক্ষয়।
কোনও মেয়ে যদি দিনের পর দিন তার চেপে রাখা কষ্ট সহ্য করতে করতে এক পর্যায়ে জমা ক্ষোভের প্রকাশ কোন কাছের মানুষের কাছে বলতে যায় তাকে দয়া করে বলবেন না যে, তোমার মানিয়ে নেয়া উচিৎ কিংবা কোনও অজুহাতে তাকে দূরে ঠেলে দেবেন না, হয়তো এইটুকু বলতে পারাতেই তার কষ্টের ক্ষীণকায় মুক্তি লুকিয়ে আছে।
পারিবারিক আর্থিক ব্যপারে সিদ্ধান্ত নিতে না দেয়াঃ
নিজের ঘর, সংসার, সন্তান এর ব্যপারে কোনও সিদ্ধান্তই যখন স্বামী একা নেন এটি একজন স্ত্রীর জন্য একটি মানসিক চাপ, নিজেকে অক্ষম ভাবার খোরাক। এটি যে শুধু একজন মানুষের অনেক বড় কষ্টের কারন তাই নয়, আত্মবিশ্বাস নষ্ট করে দেয়ার জন্য এই ধরনের আচরন দায়ী হতে পারে।
রুচিশীলতা নিয়ে প্রশ্ন তোলাঃ
কেন তুমি এমন মানুষের সাথে চলাফেরা কর? কেন তুমি আমার মতো করে বলতে বা চলতে পারনা? কেন তুমি হিজাব কর? কেন তুমি হিজাব কর না? কেন তুমি কম কথা বল? কেন তুমি বেশি কথা বল? কেন তোমার পোষাকের রুচি ভালো না?
প্রতিটি মানুষের রুচি ও পছন্দ ভিন্ন তাই এই প্রশ্নগুলোর কোনোটিই সঠিক বা স্বাভাবিক নয় বরং অপমানজনক ও অন্যায়।
সব ব্যপারে নীরবতাঃ
“হাতে মারবো না তোকে ভাতে মারবো, ভাতেও মরবি না তো তোকে জাতে মারবো”। সুশীল সমাজের সুশীল নির্যাতনের আরেকটি ধরন এটি, সবসময় গোমরা মুখ করে রাখাটা নিজেকে একরকম অসুখী প্রমান করারই মতো। স্ত্রীর সব কথার উত্তর না দেয়া বা কোনো প্রশ্ন করলে উত্তর না দিয়ে চুপ থাকা অবহেলা করা এগুলো যে অপরপক্ষের মনে কতটা নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে তা বলাই বাহুল্য। এর ফলে স্ত্রী ভাবতে থাকেন স্বামীর অসুখী হওয়ার কারন সে নিজে। প্রতিনিয়তই চলে এমন ব্যবহার শুরু হয় চরম অপরাধবোধ, ভয়ে ভয়ে থাকা, সঠিক ভাবে তার দোষটা পর্যন্ত তাকে বেশীরভাগ সময় বলা হয় না, এক পর্যায়ে সে ভাবতে শুরু করে সে ভাল ব্যবহারের যোগ্যই নয়।
শারীরিক প্রভাব:
আরেকটি ভীতিকর ব্যপার যা আমরা অনেকেই জানি না তা হলো প্রতিনিয়ত মানসিক নির্যাতনের ফলে একজন মানুষের শরীরে ভয়ানক প্রভাব ফেলতে পারে। তিলে তিলে দানা বাধতে পারে ভয়ানক ব্যাধি। বিষণ্ণতা ও ক্রোধ জনিত মানসিক রোগ, বিভিন্ন রকম স্নায়োবিক রোগ যার ফলে হতে পারে শরীরের প্রতিটি অঙ্গের সাথে সম্পৃক্ত সব রোগ সহ হৃদরোগ পর্যন্তও।
কখনও বা কোনও শিক্ষামূলক কাজ অথবা কোন বিষয় স্ত্রী শিখতে আগ্রহ প্রকাশ করলে তাকে উৎসাহ দেয়ার পরিবর্তে তাকে পেছনে টেনে ধরা হয়, কখনো তাকে বলা হয় ‘তুমি কি পারবে?’ কখনো বা তাকে সরাসরি নিষেধ করার বদলে তাকে বুঝানো হয় সে এই কাজ বা শিক্ষার যোগ্য নয়। এই আচরনগুলো একটা মানুষের আত্মবিশ্বাস আর মনবল ভেঙ্গে দেয়ার জন্য যথেষ্ট।
উপরে উল্লেখিত প্রতিটি আচরণই ভীষণ অমানবিক। অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায় গর্ভবতি মায়েরাও এই অমানবিকতা থেকে বাদ যায় না। এইসবগুলো আচরণের জন্য একজন মানুষকে অপরাধি বলা যেতে পারে অনায়াসেই। অথচ খুবই দুঃখজনক হলো আমাদের সমাজে এই ধরনের মানুষগুলো দিব্যি ভালোমানুষের পোষাকে ঘুরে বেড়ায় আবার অন্যকে মানবতার উপদেশও দিয়ে বেড়ায়। আর আড়ালে অসহায় হয়ে থেকে যায় ভুক্তভুগিরা; কখনো সম্পর্ক টিকিয়ে রাখার দায় অথবা কখনো লোকভয়।
সকলের কাছে অনুরোধ রইলো, আপনার চারপাশে যদি এমন কেউ থাকে তাকে সাহায্য করুন, আর কিছু না হোক তার মনোবল আর আত্মবিশ্বাস বজায় রাখতে তার পাশে ইতিবাচক ভূমিকা রাখুন।
You've been UpVoted via the UpVote Experiment 002 Bot. Depending on my VP & the price of STEEM you should get a $.01-$.03 for your trouble.
Read more about this experiment here.
Thank You - @blueorgy