“রক্তের দাগ”"" **প্রথম চ্যাপ্টার: অন্ধকারের প্রথম চিহ্ন**
গ্রামটা একেবারে নিস্তব্ধ ছিল। রাতের অন্ধকার ছড়িয়ে পড়েছে চারপাশে, আর একমাত্র জোনাকি পোকাগুলোই ছিল যাদের আলোকিত নাচন এই তিমির মধ্যে স্বপ্নময় আভা ছড়াচ্ছিল। মৃদু বাতাসের কারণে গাছপালাগুলো এমনভাবে ঢলতে থাকছিল যেন তারা কোনো গোপন কথার আলোচনা করছে। কিন্তু, এই সুন্দর দৃশ্যের আড়ালে ছিল এক ভয়ঙ্কর আসন্ন বিপর্যয়ের অনুভূতি।
মধ্যরাতে ঘুমন্ত গ্রামের জন্য একটা অসাধারণ রাত ছিল। সকলেই জানত যে, গ্রামের পাশের জঙ্গলের মধ্যে কিছু অদ্ভুত ঘটনা ঘটে। কেউ তা প্রকাশ্যে না বললেও, সবাই যেন অজান্তেই সেই অন্ধকার জঙ্গলের দিকে চেয়ে থাকত। সেখানে যাদের পা পড়েছে, তারা কখনো ফিরে আসেনি। জনশ্রুতি ছিল যে, সেই জায়গায় ভুতুড়ে কিছু আছে যা একে অপরের কাছে মিথ্যা পরিণত করে দেয়।
নিমজ্জিত ঘুম থেকে আচমকা উঠে পড়ে স্নেহা। সারা রাত ঘুমাতে পারেনি সে, মনে মনে অস্বস্তির কারণে তার ঘুমভাঙা অবস্থা। চাঁদের আলো পরেছে তার ঘরের জানলার গ্লাসে, আর এ আলোয় তার মুখের কেমন যেন এক চিন্তিত ভাব ফুটে উঠেছে। তার স্বামী রাহুল, এক বছরের পুরনো স্বপ্ন পূরণের জন্য প্রস্থান করেছে, এবং তিনি এখনও গ্রামে ফিরে আসেননি। স্নেহা জানত, আজ রাতে কোনো কিছু ঘটবে, তার সমস্ত অনুভূতি তাকে সতর্ক করে দিয়েছে।
স্নেহা ধীরে ধীরে বিছানা থেকে উঠল এবং জানালা দিয়ে বাইরে তাকাল। পুরো গ্রাম একবার ঘুরে দেখল সে, তবে কিছুই অস্বাভাবিক মনে হলো না। কিন্তু, গ্রামটার প্রান্তে অবস্থিত পুরনো বাড়িটা, যেখানে সবকিছু ঘটে তার দিকে তার নজর ছিল। বাড়ির দেয়াল দিয়ে ছড়িয়ে পড়া আগুনের আলো কিছুটা উজ্জ্বলিত করছিল, আর তার ভেতর থেকে কেমন যেন একটা রহস্যময়তা ছড়িয়ে পড়ছিল।
একটা ভয়াবহ চিন্তা স্নেহার মনে ঘুরপাক খাচ্ছিল, কিন্তু তার কিছু করার ছিল না। তার স্বামীকে ফোন করলেও তার ফোন বন্ধ ছিল। স্নেহা সিদ্ধান্ত নিল যে, তাকে কোনোভাবেই নিজেকে সুরক্ষিত রাখতে হবে, এবং অবশেষে সে সেই পুরনো বাড়ির দিকে পাড়ি দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিল। রাতের এই অন্ধকারে, সে জানে যে এটি একটি বিপদজনক সিদ্ধান্ত, তবে তার স্বামীকে ফিরে পাওয়ার আকাঙ্ক্ষা তাকে সব বাধা অতিক্রম করতে প্রেরণা জুগিয়েছে।
বাড়ির দিকে যাওয়ার পথে, স্নেহার মনে হয়েছিল যে জঙ্গলের ছায়া তার চারপাশে সেঁটে রয়েছে। সে হাঁটছিল, মনে মনে প্রতিটি শব্দের প্রতি সতর্ক ছিল। পাথরের সাথে তার পায়ের নিচের মাটির আর্দ্রতা টের পাচ্ছিল সে। হঠাৎ, তার পায়ের তলায় কিছু কিছু কাঁদানো অনুভব হল—যা মনে হলো যেন কোনো প্রাণীর কাঁদন। স্নেহা আরও বেশি চিন্তিত হয়ে পড়ল। তার চোখগুলো ভয় থেকে ভরে উঠল এবং সে মনে মনে মন্ত্র পড়তে লাগল।
পুরনো বাড়ির সামনে এসে স্নেহা থেমে গেল। বাড়ির দরজা একটু খোলা ছিল এবং ভেতর থেকে এক ধরনের অদ্ভুত শব্দ আসছিল। যেন কারও কান্না, কারও চিৎকার মিশে যাচ্ছে। স্নেহা অগ্রসর হল, দরজা খুলে ভিতরে প্রবেশ করল। পুরনো বাড়ির ভেতরের অবস্থা দেখে তার বুক ধড়ফড় করতে লাগল। ধুলো-ময়লা আর পোকামাকড়ের উপস্থিতি ছাড়াও, ঘরের এক কোণে একটি সাদা কাপড় বিছানো ছিল।
হঠাৎ, স্নেহার নজর পড়ল ওই কাপড়ের উপর একটি অদ্ভুত চিহ্ন দেখতে—যা মনে হচ্ছিল যেন রক্তের দাগ। তার মনে হল, এই চিহ্নটা যেন কিছু একটা ঘটেছে তার সংকেত। স্নেহার হৃদপিণ্ড দ্রুত গতিতে স্পন্দান করতে লাগল। সে বুঝতে পারছিল যে, এই বাড়ির সঙ্গে কোনো ভয়াবহ কিছু যুক্ত রয়েছে।
তারপরে স্নেহা এক টুকরো কাগজের ওপর নজর দিল যা কাপড়ের পাশে পড়ে ছিল। কাগজের ওপর কিছু লেখা ছিল, কিন্তু শব্দগুলো খুবই অস্পষ্ট। স্নেহা লাইটের সাহায্যে কাগজের লেখা পড়ার চেষ্টা করল। কিছু পড়তে পারছিল না, কিন্তু যতটুকু বুঝতে পারল তা ছিল কিছু অশুভ সংকেত এবং নির্দেশ। কাগজটি পড়তে গিয়ে স্নেহা অনুধাবন করল যে, তার স্বামীকে নিয়ে একটা বিপদময় পরিকল্পনা করা হয়েছে।
নির্দেশ অনুযায়ী, স্নেহা জানতে পারল যে, তাকে এখনই এই বাড়ি ছেড়ে চলে যেতে হবে। কিন্তু, সে এখনও জানত না যে তার স্বামী কোথায় আছে এবং কী ঘটেছে। অন্ধকার ঘরে তার স্নেহার কেবল একটি অপূর্ণ এবং অমীমাংসিত সত্যের সাথে মোকাবিলা করতে হচ্ছে। তার মনে হঠাৎ একটি ভয়ঙ্কর অনুভূতি এল—যে তার স্বামী শুধু দূরে নয়, বরং কিছু অন্যভাবে বন্দী রয়েছে।
নির্ভীক স্নেহা তার চলার পথে ফিরে আসল, কিন্তু তার মনে চিন্তার এক ভীষণ অন্ধকার জমে উঠেছে। বাড়ির অদূরে এক জায়গায় সে কিছু আলো দেখতে পেল। সম্ভবত, গ্রামে কেউ তার সাহায্য করতে পারে। তবুও, স্নেহার মনে পুরোপুরি পরিষ্কার না হওয়া এক ভয়ের গরগর আওয়াজ শুরু হলো। রাতের অন্ধকারে সে শুধু স্বামীর জন্য চিৎকার করতে পারে।
এই প্রথম চ্যাপ্টারটি ছিল স্নেহার জীবনের এক ভয়ঙ্কর রাতের শুরু, যেখানে তিনি একটি অন্ধকার এবং রহস্যময় সত্যের মুখোমুখি হচ্ছেন। তার সঞ্চিত সাহস এবং প্রতিশ্রুতি, তাকে আগামী দিনগুলোতে আরো কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি করতে সহায়তা করবে।