বর্ষার শেষ দিক। গ্রামের পাশের সেই পুরনো খালের দিকে মাছ ধরতে যাওয়ার একটা আলাদা আনন্দ আছে। সারাদিন ঝিরঝির বৃষ্টি হয়ে সন্ধ্যার দিকে আকাশটা যখন পরিষ্কার হয়, তখন খালে নাকি মাছ ভেসে ওঠে। আমি আর আমার বন্ধু রহিম ঠিক করলাম, আজ রাতে টর্চ আর ছিপ নিয়ে মাছ ধরতে যাব।

খালটা গ্রামের একেবারে শেষ মাথায়। চারপাশে ঝোপঝাড় আর বড় বড় কদম গাছ। লোকজন বলে, এই জায়গাটা নাকি ভুতুড়ে, রাতে নাকি অদ্ভুত আওয়াজ শোনা যায়। কিন্তু আমাদের তখন শুধু মাছের লোভ। ভয়ের কথা ভুলে আমরা টিপটিপ আলোতে খালের ধারে গিয়ে বসলাম।

শুরুতেই আমাদের ভাগ্য ভালো। রহিম ছিপ ফেলতেই একটা বড়সড় শিং মাছ উঠে এলো। আমি তখন বেশ উৎসাহ নিয়ে নিজের ছিপ ফেললাম। রাতের নিস্তব্ধতায় শুধু জলের ছলাৎ ছলাৎ শব্দ, আর মাঝে মাঝে ঝিঁঝি পোকার ডাক শোনা যাচ্ছিল। ঠিক তখনই হঠাৎ খালের ওপারে কেমন যেন সাদা সাদা কিছু নড়তে দেখলাম।

প্রথমে ভেবেছিলাম কুয়াশা হবে। কিন্তু ভাল করে তাকাতেই দেখি, লম্বা চুলওয়ালা এক সাদা কাপড় পরা মহিলা দাঁড়িয়ে আছে! তার চোখ যেন অস্বাভাবিক লালচে, আর ঠোঁটে অদ্ভুত হাসি। ভয়ে আমার হাত থেকে ছিপটা জলের মধ্যে পড়ে গেল। রহিমও থতমত খেয়ে বলল,ওরে বাবা! ভূত না তো?

আমরা পালানোর কথা ভাবছি, ঠিক তখনই সেই সাদা ছায়ামূর্তি ধীরে ধীরে ভেসে খালের ওপার থেকে আমাদের দিকে আসতে শুরু করল। জলে তার পা ছোঁয় না, যেন ভেসে আসছে। আমাদের বুক ধড়ফড় করতে লাগল। টর্চের আলো ফেলতেই দেখি তার মুখটা পরিষ্কার, যেন একেবারে ফ্যাকাশে আর ভুতুড়ে।

আমি আর রহিম প্রাণপণে দৌড় দিলাম। পিছনে তাকাতেই দেখি সেই ভূতও ভেসে আসছে। মনে হচ্ছিল, এবার আর বাঁচা যাবে না। ঠিক তখনই খালের পাড়ে থাকা বাঁশঝাড় থেকে একদল ব্যাঙ একসাথে ডাকতে শুরু করল,ব্যা... ব্যা... ব্যা…। ভূতের মতো ছায়ামূর্তিটা হঠাৎ থেমে গেল।

সাহস সঞ্চয় করে রহিম একটু জোরে টর্চের আলো ফেলল। আরে! ওটা ভূত নয়, আসলে খালের পাশে কাপড় শুকোতে দিয়ে গিয়েছিল গ্রামের এক লোক। বাতাসে কাপড় নড়ে গিয়ে দূর থেকে ভূতের মতো লাগছিল! আর সেই “লাল চোখ”? সেটা ছিল কাছের একটা গাছের ফাঁকে জ্বলজ্বল করা জোনাকি!

আমরা দু’জন হো হো করে হেসে উঠলাম, যদিও কিছুক্ষণ আগেও মনে হচ্ছিল প্রাণটাই শেষ হয়ে যাবে। শেষমেশ সাহস করে আবার মাছ ধরা শুরু করলাম। যদিও সেদিন ভয়ে আমাদের হাত কাঁপছিল, তবুও ঝুড়ি ভর্তি মাছ নিয়ে বাড়ি ফিরেছিলাম।