নিঃস্বার্থ ভালবাসা...।।

in #story7 years ago

নতুন বৌ কে বরণ করতে ঘরের সবাই দরজায় দাড়িয়ে আছে।
পিছন থেকে নতুন বৌ এর শাড়ির আচঁল টেনে ধরে বড় বড় চোখে সবার দিকে তাকিয়ে আছে একটা আড়াই বছরের মেয়ে।

টুকটুক ...
কিন্তু অন্যান্য পরিবেশের মত কেউ নতুন বৌ এর সাথে আসা বাচ্চা টা কে এই প্রশ্ন করসে না।

আমি ইফতি।
আজ ঘরে আসা নতুন বৌ টি আমার স্ত্রী তনু।
আর যেই মেয়েটি তনুর শাড়ির আচঁল ধরে ঢুকছে ও আমাদের মেয়ে।

খুব অবাক হচ্ছেন এই ভেবে বিয়ে আজকে করলাম তো বাচ্চা আড়াই বছরের কেনো?

এইটা হলো সেই ৮ মাসের আগের কথা।
প্রফেশনের দিক দিয়ে আমি হলাম ডাক্তার। সেদিন আমার রাতে ইমার্জেন্সি বিভাগে ডিউটি ছিলো। ছেঁড়া জামা পড়া একজন মহিলা তার বাচ্চাকে বুকে জড়িয়ে চিৎকার করে বলছে

  • কে আছেন আল্লাহর ওয়াস্তে আমার বাচ্চাকে বাঁচান।

আমি দৌড়ে গেলাম। বাচ্চাটা সেন্সলেস। বাচ্চার পালস, প্রেসার ,হার্টবিট চেক করলাম। সবই নরমাল। হয়ত বড় কোন শক খেয়েছে তাই ভয়ে সেন্সলেস হয়ে গিয়েছে। কিন্তু তার মা এর দিকে তাকিয়ে আমি বলতেই নিচ্ছিলাম যে সে সুস্থ তাকিয়ে দেখলাম তার শরীরে অনেক আঘাত এর দাগ। মনে হচ্ছিলো কেউ অনেক মেরেছে। সেখান থেকে এই দুইটা প্রাণ কোনরকমে পালিয়ে এসেছে। মুহুর্তে মহিলাটা আমার চোখের সামনে মাথা ঘুরিয়ে মাটিতে পরে গেলেন। এরপর শুরু হলো তার চিকিৎসা .. নার্স যত তার কাপড় শরীর থেকে সরাচ্ছিলেন তার ঘা তত ফুটে উঠছিলো ...কিছু নতুন আর কিছু পুরান।
তাকে আমরা স্যালাইন দিয়ে একটা সিটে শুইয়ে দিলাম। তার পাশে বাচ্চাটাকে।

ওদের সাথে আর কেউ নেই। কোত্থেকে এসেছে কি হয়েছে কিছুই জানতাম না। পুলিশ কে ইনফর্ম করা উচিৎ নাকি তাও বুঝতে পারছি না। মায়ের আগে মেয়েটার ই সেন্স আসলো। একটা ছোট পরীর বাচ্চা। মনে হচ্ছিলো এত মানুষ ও কখনোই দেখে নাই। বড় বড় চোখ দিয়ে তাকিয়ে আছে সবার দিকে। আর তার পাশে শুয়ে থাকা মাকে বারবার ডাকছে। আমি সামনে গিয়ে জিজ্ঞেস করলাম

  • তোমার নাম কি মামনি?

  • টুকটুক

নাম বলার পর টুকটুক তাকিয়ে আছে পাশের বেডের লোক টার বিস্কুটের দিকে। বুঝতে পারলাম বাচ্চা মানুষ ক্ষুধা পাইসে। আমি আমার টাকা দিয়ে টুকটুক কে বিস্কুট আনিয়ে দিলাম।
ও বেডে পা ঝুলিয়ে খুব মজা করে বিস্কুট খাচ্ছে। আবার তার মা কে ও সাধছে। ইমার্জেন্সি ওয়ার্ড এর সবার আজ এই বাচ্চা মেয়েটার দিকে মনোযোগ..
টুকটুক বেড থেকে নেমে দাড়াতেই যাচ্ছিলো কিন্তু হাটতে পারছে না। খেয়াল করে দেখলাম ওর পায়ে ক্ষত।
আমরা ড্রেসিং করতে ওকে কোলে করে বসালাম।
আমরা টুকটুক কে অনেক প্রশ্ন করলাম কিন্তু কোন উত্তর দেয় না। শুধু নাম বলে নিজের আর মা কে ডাকে। আবার নিজের খেয়াল মত একা একা দুই একটা কথা বলে।

প্রায় ১.৫ ঘন্টা পর মহিলার জ্ঞান ফিরলো।
জ্ঞান ফিরা মাত্র সে কাঁদছে আর তার মেয়েকে জড়িয়ে ধরে নাকে চোখে মুখে চুমু খাচ্ছে।

এরপর তাকে আমরা জিজ্ঞেস করলাম আসলে কি ঘটেছে। কেন সে এখানে?

-আপনার নাম কি? এখানে কেন? পরিবারের সবাই কোথায়?

-আমার নাম তনু। ও আমার মেয়ে টুকটুক। আমার পরিবারের সবাই সবুজবাগ থাকে।

-আপনার পরিবারের কারো ফোন নাম্বার দিন ..আর আপনার সাথে কি হইসিলো? গায়ে এত দাগ কিসের?

  • প্লিজ আপনারা আমার স্বামীর বাড়ির কারো সাথে যোগাযোগ কইরেন না। আমি আমার আম্মুর নাম্বার দিচ্ছি। পারলে উনাদের একটু আসতে বলেন। উনারা গাজীপুর থাকে।

-আচ্ছা দিন উনাদের নাম্বার .. কিন্তু আপনার স্বামীকে কেন না?

  • খুনী ওরা খুন করতে নিসিলো আমার বাচ্চাটাকে আর আমাকে।

চিৎকার করে তনু বলছে। আমরা সবাই তাকিয়ে আছি। তনু কাঁদছে। আর টুকটুক ভয়ে তার মা কে জড়িয়ে ধরে আছে।

-বলেন কি? দাড়ান পুলিশ কে ইনফর্ম করি।

আমি পুলিশ আর তনুর মায়ের বাসায় ফোন করে জানালাম।

পুলিশ আসতেই তনু সব খুলে বলল।

বিয়েটা হয়েছিলো ৪ বছর আগে। প্রেমের বিয়ে ছিলো। অনেক ধুমধাম করেই আবিরের সাথে বিয়ে দিয়েছিলো তনুর বাবা মা। আবির সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার আর তনু বুয়েট থেকে করা আর্কিটেক্ট ... বিয়ের পর তনু তার যৌথ পরিবারে থাকতেন। বিয়ের আগে কথা ছিলো তনু কে তারা চাকরি করতে দিবে। কিন্তু পরবর্তীতে তারা তনুকে চাকরির ইন্টার্ভিউ দিতে গেলেই হাবিজাবি বলত। শ্বশুর শ্বাশুড়ী দেবর ননদ এমনকি প্রাণ প্রিয় স্বামীও। কারণ ছিলো বিয়ের সময় তনরু বাবার যা যা দেওয়ার কথা ছিলো তার অর্ধেক ও দেন নি। তনুর বাবার দেওয়ার সামর্থ্য থাকা স্বত্তেও তিনি দেয় নি কারণ তিনি ঠিক আগ মুহুর্তে আচঁ করতে পেরেছিলেন আবিরের পরিবার লোভী। এই না পাওয়ার জীদ তারা তনুর উপর দিতে উঠাতো। ঘরের কাজ তো নরমাল কথা তারা উঠতে বসতে তনুকে গালিগালাজ করতো। আবির ও বাদ যায় নি। সে ও সবার সাথে তাল মিলিয়ে তনু কে মানসিক নির্যাতন করত। তনুকে তার বাবার বাড়ি পাঠানো হত বাকি সব দাবি দানা চাইতে। কিন্তু লজ্জায় বাসায় কাউকে বলত না আর ফিরে যেত খালি হাতে। আস্তে আস্তে ওদের মুখ এর
সাথে হাত ও চলত। ওরা ভাবলো একটা বাচ্চা হলে বাচ্চার মায়ায় পরে তনু সংসার বাচাঁতে ওর বাসা থেকে যৌতুক আনবে। কিন্তু টুকটুক হওয়ার পরও তনু তার বাসায় কিছুই বুঝতে দেয় নি। কিছুই বলে নি একাই সহ্য করেছে। তনু ভেবেছিলো বাচ্চার মায়ায় বাসার সবাই ঠিক হয়ে যাবে। জন্মের পর থেকেই টুকটুক কে কেউ আদর করতো না। এমনকি আবির ও টুকটুক কে কোলে নিত না। টুকটুক আবিরের দিক তাকিয়ে হাসতো। আস্তে আস্তে কথা বলা শিখলো বাবা বাবা বলে ডাকতো। আবির খালি ধুর ধুর বলে তাড়িয়ে দিতো। তনু ভাবতো একদিন সব নরমাল হবে। কিন্তু কিছুই নরমাল হচ্ছিলো না। বরং খারাপের দিকে যাচ্ছিলো। টুকটুক এর জন্য আলাদা কিছু রান্না করতে গেলে তনুর শ্বাশুড়ী হাত থেকে টেনে রেখে দিতো। বলত " তোমার বাপের বাড়ির থেকে এনে খাওয়ায়। এখানে এত আল্লাদ দেখানোর কিছু নাই। " তনু অবাক হত ওদের ফ্যামিলির বাচ্চা অথচ ওরা এমন করছে সামান্য কিছু যৌতুকের জন্য। আস্তে আস্তে টুকটুক বড় হচ্ছিলো কিন্তু টুকটুকের পরনের একটা জামা তনুর বাবা বাড়ি থেকে আনতে হতো ..আস্তে আস্তে ওরাও টের পাচ্ছিলো তনুর উপর হওয়া নির্যাতন..তনু কে ওরা চলে আসতে বললেও তনু সব ঠিক হয়ে যাবে এই আশ্বাসে অপেক্ষা করছিলো। শেষ কিছুদিন যাবৎ আবিরের দ্বিতীয় বিয়ের ব্যপারে তনু হালকা হালকা শুনছে আর তনু কে ডিভোর্স দেওয়ার ব্যাপারেও তারা ডিশিসন নিয়েই ফেলছে.. কিন্তু তাদের মনে তখনো সেই লোভ। তনুকে ডিভোর্স দিলে তনুর দেনমোহর আর টুকটুক এর ভরণপোষণ তো তাদের দিতে হবে। এত টাকা ওরা কেন দিবে? তাই ওরা সিদ্ধান্ত নিলো ওদের কে মেরেই ফেলবে।
আজ দুপুরে রান্নাতে লবন বেশি হয়েছে এই নিয়ে প্রথমে গেঞ্জাম লাগালো তনুর শ্বাশুড়ী ..সারাদিন ঘ্যান ঘ্যান করার পর আবির সন্ধ্যায় বাসায় আসার পর সবাই মিলে আরো একবার শুরু করলো।
শেষ ৪ বছরে তনু কখনোই তাদের কথা উত্তর দেয় নি.. আজ তনু কে তারা কথায় কথায় বলে ফেলল - টুকটুক অবৈধ কারো সন্তান এটা শুনে তনু বেসামাল হয়ে গেল। সে কিছুতেই এটা নিতে না পেরে উত্তর দিয়ে বসলো। আর তাদের শুরু হলো গায়ে হাত তোলা। এতদিন তারা কখনো টুকটুকের গায়ে হাত দেন নি। আমাকে মারার সময় টুকটুক কান্না করসিলো ভয়ে। আবিরকে এতটুকু একটা বাচ্চা আটকানোর চেষ্টা করসিলো। তনুর শ্বাশুড়ী টুকটুক কে হাতের সামনে থাকা চটির জুতা দিয়ে বাইরাচ্ছিলো। তনুর শ্বশুর বলসিলেন
" ২ টারেই মাইরা ফেলাও। ডিভোর্স দিলে খরচ লাগে ১০ লাখ। মাইরা ফেললে পুলিশ রে মাত্র ২ লাখ দিয়ে লাশ গুম করা যাবে।"

এই কথা শুনে তনুর মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পরলো। তনু মাইর খেয়ে উঠে দাড়াতে পারছিলো না। আর টুকটুক কে ওরা গলা চেপে ধরলো।। তনু কোন রকমে উঠে দাড়িয়ে দরজার পাশ থেকে ঝাড়ু নিয়ে সবাইকে বাইড়াতে বাইড়াতে টুকটুক কে ওদের কাছ থেকে টেনে নিয়ে বাসা থেকে বের হয়ে বাইরে থেকে লক করে হাসপাতালে এসেছে।

সম্পূর্ন স্টেটমেন্ট নেওয়ার পর পুলিশ তাদের ঠিকানা অনুযায়ী এরেস্ট করতে গেলেও বাসায় কাউকে পেলো না। তারা আসার আগেই কোন ভাবে এরা বের হয়ে গিয়েছিলো।

তনু অনেকদিন হাসপাতালে ভর্তি ছিলো। সাথে টুকটুক ও। তনুর বাসার মানুষ বাদী হয়ে আবিরের পরিবারের নামে মামলা করলো। টুকটুক হাসপাতালে থাকতে একদিন আমাকে বাবা ডেকে ফেলল। আমার ও কেমন যেন একটা মায়া জন্মায়া গেলো টুকটুকের জন্য। যেদিন ওরা হাসপাতাল থেকে চলে যায়। সেদিন টুকটুক বারবার আামার দিকে তাকাচ্ছিলো। আর তনুর চোখের সেই অসহায়ত্ব আমি স্পষ্ট বুঝতে পারসিলাম।

অনেকদিন পর তনুকে আর টুকটুককে খুব মনে পড়ছিলো ..আচ্ছা ওরা এখন কেমন আছে? তনু কি আবার উঠে দাড়াইছে? টুকটুক কি আর কখনো বাবার আদর পাবে না?

খুব অস্থির লাগসিলো। মায়ের কাছে গিয়ে তনুর কথা বললাম.. মা এর আগেও আমার মুখে ওদের গল্প শুনেছে।
আমার মা ও একজন ডাক্তার্। বাবা নাই। ছোট বোন বিয়ে করে হাজবেন্ড এর সাথে দেশের বাহিরে থাকে।

মা সব শুনে আমাকে বললেন।

"-ইফতি তুমি যদি তনুকে বিয়ে করতে চাও আমার দিক থেকে কোন সমস্যা নাই। কিন্তু সমাজ অনেক খারাপ জায়গা। একটা ২৮ বছর বয়সী আনম্যারিড ছেলে আর একটা ২৭ বছর বয়সী ২.৫ বছর বয়সী বাচ্চা সহ ডিভোর্সি মেয়েকে নিয়ে অনেক আলোচনা করবে। যদি সেটা প্রতিরোধ করার ক্ষমতা নিয়ে সামনে আগাও আমি তোমার সাথে আছি। আর ভুলে যেয়ো না তনু একবার এক নরক থেকে উঠে আসছে আর ঐ বাচ্চাটাও একটা বাবার আদর পায় নাই।
তুমি যদি মনে করো তুমি তাদের সুখি রাখতে পারবে তাহলে আমি তোমার সাথে ছিলাম আছি এবং থাকবো। আমি কখনো তনুকে আগের কথা মনে করিয়ে কষ্ট দিবো না। আর আমি কখনো বাচ্চাটাকে বুঝতে দিবো না এটা শুধু ওর মায়ের শ্বশুরবাড়ি এটা ওর দাদুর বাড়ি জেনেই ও বড় হবে।"

সেদিন মায়ের কথা গুলা শুনে আমি খুব সাহস পেয়েছি আর গর্ব বোধ করসিলাম আমি এমন মায়ের সন্তান।

আমার কাছে তনুর বাসার ঠিকানা ছিলো। মা কে একদিন চলে গেলাম ওদের বাসায়। বিয়ের প্রস্তাব দিলাম। তারা খুব অবাক। আমি আনম্যারিড তারপরও কেনো তনুকে বিয়ে করতে চাচ্ছি। তনু রাজি ছিলো না। পরবর্তীতে সে পরিবারের জোরাজোরি তে রাজি হলো। কিন্তু ওরা টুকটুক কে তাদের সাথে রাখতে চেয়েছিলো।

আমাদের বিয়ের আগে তনুর বাবা আমাকে জিজ্ঞেস করেছিলেন। আমি কিছু চাই কিনা।

আমি উত্তর দিয়েছিলাম - যৌতুক হিসেবে টুকটুক কে তনুর সাথে চাই।

আমার আত্মীয়স্বজন সবাই তনুর এই দূর্ঘটনা জানতেন কিন্তু একটা বার জিজ্ঞেস করেন নি। কখনোই না। টুকটুক এর নতুন করে আমার নামের সাথে মিলিয়ে নাম রাখলাম " ফাঈজা আহমেদ টুকটুক"

আলহামদুলিল্লাহ আমরা ৩ জন এখন ভালো আছি।
যে বা যারা বলেছিলেন " ডিভোর্সি মেয়েকে বিয়ে করবা কেন? তোমার জন্য দেশে সিঙ্গেল মেয়ের অভাব? "

তাদের উদ্দেশ্যে বলসি

  • ডিভোর্সি মেয়েরাও মানুষ ..ডিভোর্সি একটা ছেলের বিয়ের জন্য যদি সিঙ্গেল মেয়ে খোঁজা হয় তো ডিভোর্সি মেয়ে কেনো নয়?
    .
    .
    .

    .
    .
    .
    Image: pixabay
Sort:  

What language is this i like the writing?

@ataayo thanks so much , its bangla language :)

I can't undertand the language but I love the featured picture

thanks so much :)

i love the text.. but I can't read it.. I just love looking at it.

STEEMIT ACHIEVERS PHILIPPINES
Soar High Be An Inspiration
#steemitachievers