ছোটবেলার স্মৃতিগুলো আজও মনে পড়লে মনটা অদ্ভুত এক আনন্দে ভরে যায়। বিশেষ করে মামার সাথে বড়শি দিয়ে মাছ ধরার সেই দিনগুলো ছিল আমার জীবনের সবচেয়ে সুন্দর অভিজ্ঞতাগুলোর একটি। তখন জীবন ছিল খুবই সহজ, কোনো দুশ্চিন্তা ছিল না,ছিল শুধু খেলা, হাসি আর প্রকৃতির সাথে মিশে থাকার আনন্দ।

গ্রামের বাড়িতে ছুটি কাটাতে গেলেই মামা আমাকে নিয়ে যেতেন কাছের পুকুর বা খালের ধারে। ভোরের আলো ঠিকমতো ফুটে ওঠার আগেই আমরা বের হয়ে পড়তাম। হাতে থাকত বাঁশের তৈরি বড়শি, সুতা, কাঁটা আর টোপ হিসেবে কেঁচো বা পিঁপড়ার ডিম। মামা খুব ধৈর্য নিয়ে আমাকে সবকিছু শিখাতেন,কিভাবে সুতা বাঁধতে হয়, কিভাবে টোপ লাগাতে হয়, আর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, কিভাবে চুপচাপ বসে অপেক্ষা করতে হয়।পুকুরপাড়ে বসে থাকতাম আমরা দু’জন। চারপাশে তখন পাখির ডাক, বাতাসে কচি ঘাসের গন্ধ আর পানির উপর ভাসতে থাকা রোদের ঝিলিক। বড়শি পানিতে ফেলেই আমার মনে হতো, এই বুঝি মাছ ধরলাম! কিন্তু মামা হেসে বলতেন, ধৈর্য ধর, মাছ ধরতে হলে তাড়াহুড়ো করলে চলবে না।সেই কথাগুলো আজও মনে গেঁথে আছে।

হঠাৎ করে যখন বড়শির সুতা একটু নড়ে উঠত, তখন বুকের ভেতর ধক করে উঠত। মামা! মাছ ধরেছে!উত্তেজনায় চিৎকার করে উঠতাম। মামা তখন শান্তভাবে বলতেন,আস্তে, টান দিস না।তারপর দু’জনে মিলে ধীরে ধীরে বড়শি তুলতাম। ছোট কোনো মাছ উঠলে যেমন আনন্দ পেতাম, তেমনি বড় মাছ উঠলে তো আনন্দের সীমা থাকত না। কখনো আবার মাছ ছুটে যেত, তখন একটু মন খারাপ হতো, কিন্তু মামা বলতেন,এই তো মজা, সব সময় জিতলে খেলা জমে না।মাছ ধরার ফাঁকে মামা আমাকে গল্প শোনাতেন—তার শৈশবের কথা, গ্রামের পুরোনো দিনের গল্প, আর জীবনের ছোট ছোট শিক্ষা। সেই গল্পগুলোর মধ্যেই আমি শিখেছিলাম প্রকৃতিকে ভালোবাসতে, ধৈর্য ধরতে আর অল্পতেই খুশি হতে। দুপুরের দিকে বাড়ি ফিরে ধরা মাছগুলো দেখিয়ে সবাইকে অবাক করতাম, আর মা সেই মাছ দিয়ে সুস্বাদু রান্না করতেন।

আজ সময় অনেক বদলে গেছে। বড়শির জায়গা নিয়েছে মোবাইল, পুকুরপাড়ের জায়গা নিয়েছে কংক্রিটের দেয়াল। তবুও চোখ বন্ধ করলে আজও দেখতে পাই,আমি আর মামা পুকুরপাড়ে বসে আছি, বড়শি পানিতে, আর মনভরা হাসি মুখে। সেই ছোটবেলার মাছ ধরার আনন্দময় দিনগুলো আমার হৃদয়ে চিরকাল অমলিন হয়ে থাকবে।