চেম্বার কথন: এক রুগীর গল্প যেখানে আমার অভারকনফিডেন্স (Over Confidence) আমাকে লজ্জায় ফেলেছে!
এক রুগীর গল্প যেখানে আমার অভারকনফিডেন্স (Over Confidence) আমাকে লজ্জায় ফেলেছে!
একজন ক্ষেত-মজুর বাংলাদেশী রুগী এসেছেন আমার চেম্বারে। উনার ফোরম্যান নিয়ে এসেছেন। রুগীর বয়স ৩৩ বছর। হ্যাংলা-পাতলা লম্বা একজন রুগী। এক বছরের একটু বেশী সময় ধরে ওমানে আছেন। কোন প্রকার প্রচেষ্টা ছাড়াই ছয়-সাত মাসে উনার ওজন কমেছে ১১ কেজি। আগে ছিল ৬২ কেজি। আমার চেম্বারে ওজন পাওয়া গেল ৫১ কেজি!
এর পাশাপাশি উনার আরেকটা সমস্যা ছিল। ঘন ঘন পেশাব হয়। দিনে রাতে সব সময় একটু পর পর পেশাব করা লাগে উনার। পেশাবের এই সমস্যাও বিগত ২-৩ মাস ধরে। কোন ডাক্তার দেখান নাই তখন পর্যন্ত। উনারা এসেছেনই ডায়াবেটিস পরীক্ষার করতে! জিজ্ঞেস করে জানা গেল উনার পেশাবে কোন জ্বালা-পোড়া নাই।
নিজের পূর্ব অভিজ্ঞতা, রুগীর রোগের ইতিহাস এবং উনার শারীরিক গঠন (চিকন পাতলা লোকের ঘন ঘন পেশাব) থেকে আমার মাথায় অলরেডি সেট হয়ে গেছে যে উনি ডায়াবেটিসে ভুগছেন!! ভিন্ন কিছু হতে পারে সেটা আর মাথাতেই আসে নাই। উনার রক্তচাপও স্বাভাবিকের তুলনায় বেশী পাওয়া গেল।
ডায়াবেটিস আছেই, এটা ধরে নিয়েই টেস্ট করতে দিলাম কিছু। ডায়াবেটিসের দুইটা টেস্ট দিলাম (RBS and HBA1C), তার মধ্যে একটা বেশ দামী টেস্ট। যেহেতু রক্তচাপও বেশী পাওয়া গেছে, ডায়াবেটিসের রুগীদের কিডনী আক্রান্ত হয় বেশী, সেটা চিন্তা করে কিডনির একটা টেস্টও (S. creatinine) করতে দিলাম। পেশাবের জ্বালা-পোড়া নাই বলে পেশাব টেস্ট আর দিলাম না!
ডায়াবেটিসের দামী (৮ রিয়াল) যে টেস্টটা করতে দিলাম, সেটার উদ্দেশ্যে ছিল তিনটা; ডায়াবেটিস আছে সেটা নিশ্চিত হওয়া, নতুন নাকি অনেক পুরাতন ডায়াবেটিস সেটা সম্পর্কে একটা ধারণা পাওয়া এবং কি ধরনের ওষুধ লাগবে (ট্যাবলেট নাকি ইনসুলিন) সেটার সিদ্ধান্ত নেয়া। সাধারনত প্রথম দিনেই, ডায়াবেটিস নিশ্চিত কিনা না জেনে এই দামী টেস্ট আমি করায় না। কিন্তু আজ আমি এতটা নিশ্চিত ছিলাম যে প্রথমেই এটা করতে দিলাম (অবশ্য রুগীও রাজী ছিল)।
একই রকম চিন্তা-ভাবনা হল কিডনির সমস্যা চিন্তার ক্ষেত্রেও। ডায়াবেটিস আছেই (!), তার সাথে প্রেশারও বেশী!! কিডনির না জানি কি অবস্থা! তাই প্রথমেই কিডনির টেস্ট করতে দিলাম (আরও ৩ রিয়াল গেল)!
যখন মনে মনে প্লান করছিলাম কিভাবে রুগীর ডায়াবেটিসের চিকিৎসা শুরু করব, তখন রুগীর রিপোর্ট দেখেতো আমার চক্ষু চড়কগাছ! রিপোর্ট মোতাবেক রুগীর ডায়াবেটিসই নাই!!! কিডনিও ১০০% ভাল!! কেমনে কি!
রুগীকে ডাকলাম। ডায়াবেটিস নাই! তাহলে পেশাব কেন ঘন ঘন হচ্ছে! পেশাবে কি কিছুটা হলেও জ্বালা-পোড়া আছে যেটা ইনফেকশানের লক্ষন! উল্লেখযোগ্য কিছু না! তারপরও রুগীকে রাজী করালাম পেশাব পরিক্ষার করানো জন্যে। সেটার রিপোর্টও আসল নরমাল!
কোন দিকেই কিছু মিলে না! লক্ষণ পূরো ডায়াবেটিসের মত! কিন্তু রিপোর্ট সেটা সাপোর্ট করে না! অভার কনফিডেন্স না হয়ে (অন্য রুগীদের মত) প্রথমে বেসিক টেস্ট করালেও চলতে! সেক্ষেত্রে রুগীর ১১ রিয়াল গচ্ছা যেত না!
এগুলোর পরবর্তী ধাপ হিসাবে আরও কিছু দামী দামী টেস্ট করা লাগত। যেমন, একটা আল্ট্রাসাউন্ড পরীক্ষার করে প্রস্টেটের সমস্যা আছে কিনা দেখার জন্যে, থাইরয়েড হরমোন টেস্ট করানো, ক্যান্সার খোজা ইত্যাদি। কিন্তু রুগীর সামর্থ্য ছিল না আরো টাকা খরচ করার। তাই রোগ না ধরতে পেরে (!), তার লক্ষণ কমানোর জন্যে কিছু ওষুধ পত্র লিখে বিদায় দিলাম রুগীকে।
এই গল্পের আলোচ্য রোগ ঘন ঘন পেশাব হওয়া এবং ওজন কমে যাওয়া রোগ সম্পর্কিত কিছু উল্লেখযোগ্য তথ্যঃ
- অনিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিস ঘন ঘন পেশাবের একটা অন্যতম কারণ। অনেক ক্ষেত্রেই এটাই প্রথম লক্ষণ হিসাবে পাওয়া যায়।
- "পেশাবে ইনফেকশান" আরেকটা অন্যতম কারণ ঘন ঘন পেশাব হওয়ার। তবে এটা মহিলাদের ক্ষেত্রে বেশী হয়।
- প্রস্টেট গ্ল্যান্ড (Enlarged prostate)বড় হয়ে যাওয়া বার বার পেশাব হবার একটা কারণ। এটা শুধু পুরুষের হয়।সাধারণত একটু বয়স্ক রুগীদের এটা হতে দেখা যায়।
- কোন প্রচেষ্টা ছাড়াই ওজন কমার (Unintentional weight loss) বেশ কিছু কারণ আছে। চেম্বারে আমরা অনেক ডায়াবেটিস রুগী পায় যাদের ওজন খুব দ্রুত কমে যায়। রুগীর শরীরে যদি ইনসুলিন নামক হরমোন একেবারেই কমে যায় তাহলে দ্রুত ওজন কমে যেতে পারে।
- থাইরয়েড হরমোন অনেক বেড়ে গেলে (Hyperthyroidism) ওজন কমে যায়। যদিও রুগী বেশী বেশী খায় কিন্তু তা গায়ে লাগে না!
- যে কোন ক্যান্সার দ্রুত ওজন কমার একটা অন্যতম কারণ!
- এছাড়াও ডিপ্রেশান (depression), খাদ্যনালীর কোন সমস্যা (e.g. Coeliac disease), হার্ট ফেইল করা ইত্যাদি কারণেও ওজন কমে যেতে পারে!
ওকে। আজকে এ পর্যন্তই। আশা করি কিছু নতুন তথ্য পেয়েছেন আমার পোস্ট থেকে। কোন পরামর্শ বা প্রশ্ন থাকলে কমেন্ট এর মাধ্যমে জানাবেন। ভাল থাকুন।
আল্লাহ হাফেজ
ডা. হাফিজ
ওমান
চেম্বার কথন সিরিজের পূর্ববর্তী পোস্টঃ
মুখের একপাশ বেঁকে যাওয়া (Bell's Palsy/Facial palsy) এক রুগীর গল্প!
কয়েন গিলে (Foreign Body ingestion) ফেলা এক তরুণীর গল্প !
এন্টিবায়োটিক ইঞ্জেকশানের রিয়াকশানে (Anaphylaxis) প্রায় হারাতে বসা এক রুগীর গল্প!
বুকে বাতাস জমা (Pneumothorax) এক রুগীর গল্প!
একজন হাউজমেইডের (Housemaid) গল্প যিনি তার চাকরি হারানোর দ্বারপ্রান্তে
ফরনিয়ার গ্যাংগ্রীনে আক্রান্ত এক রুগীর গল্প
পেশাব এবং তলপেটের ব্যথা নিয়ে আসা এক রুগীর গল্প
আমি ডা. হাফিজ। ঢাকার একটা মেডিকেল থেকে ডাক্তারী পাশ করেছি। ২০১৪ সাল থেকেই দেশের বাইরে আছি। শুরুতে ২ দুই বছর ছিলাম মালদ্বীপে। তারপর থেকে ওমানে আছি গত ৭ বছর ধরে। এখানে একটা পলিক্লিনিক এ জি.পি. ডাক্তার হিসাবে কর্মরত আছি বর্তমানে।
My Discord ID: hafiz34#3722
খুব সুন্দর একটি শিক্ষনীয় পোস্ট করেছেন আপনি। এই পোস্টটা অনেক মানুষের জন্য অনেক শিক্ষনীয় হবে। আপনি অনেক গুরুত্বপূর্ণ কথা লিখেছেন। আমি একটা জিনিস জানতাম না খাবার রুজি ঠিক থাকলে বা বেশি বেশি খেলেও থাইরয়েড হরমোন বেড়ে গেলে ওজন কমে যাই। আপনার এই পোস্টটি আমাদের জন্য অনেক বেশি প্রয়োজন। ধন্যবাদ আপনাকে সুন্দর একটি পোস্ট শেয়ার করার জন্য।
আসলে এই সমস্যাটা আমাদের দেশেও বেশী, উন্নত টেস্ট করানো প্রয়োজন হয় অনেক সময় কিন্তু রোগীর সামর্থ থাকে না সেটা করানোর। অনেক ধন্যবাদ