বাংলার লোকগান ও লোকনৃত্যের বিভিন্ন প্রকারভেদ। একটি সার্বিক আলোচনা।
বাংলার লোকগান ও লোকনৃত্যের বিভিন্ন প্রকারভেদ
🙏 সকলকে স্বাগত জানাই 🙏
আজ ব্লগে আলোচনা করব বাংলার লোকগান ও নাচ বিষয়ে। বাংলার লোকগান ও লোকনৃত্য বলতে যে অবিচ্ছেদ্য অংশগুলো উল্লেখ করতে হয় সেগুলি হল-
বাউল - বাউল হল বাংলার এমন এক আদি সংগীত যেখানে মূলত সুফিবাদ এবং দেহতত্ত্ব বিষয়ক তত্ত্বকথা প্রচার করা হয়। বাংলায় সূফীবাদের এক অন্যতম স্তম্ভ হলো বাউল। পঞ্চদশ শতাব্দীতে বাউল গানের আধিক্য লক্ষ্য করা গেলেও কুষ্টিয়ায় লালন সাঁইয়ের সৌজন্যে মূলত সারা পৃথিবীতে এই সাধনার প্রচার হয়। বাউলের প্রধান যন্ত্র অনুষঙ্গ হল একতারা এবং ডুগি। এছাড়াও সাথে করতাল, বাঁশি, খোল বা ঢোল দেখা যায়।
ভাটিয়ালি - বাংলা লোকসংগীতে এক অন্যতম গান হলো ভাটিয়ালি। নদীমাতৃক বাংলাদেশের মূলত ভাটি অঞ্চলে এই গানের ব্যাপক প্রচলন। বাংলাদেশের উত্তরভাগে ময়মনসিংহ অঞ্চলে ব্রহ্মপুত্র নদীর উত্তর-পূর্ব দিকে ভাটি অঞ্চলে ভাটিয়ালি গানের সৃষ্টি এবং ব্যাপকভাবে প্রচার দেখা যায়। এই গানগুলির প্রধান উপজীব্য বিষয়ে থাকে মাঝি, দাঁড়, নৌকা ইত্যাদি।
ধামাইল - ধামাইল হল বাংলাদেশের সিলেট এবং ময়মনসিংহ অঞ্চলের একটি বিশেষ লোকগান এবং লোকনৃত্যের নাম। এই গানগুলো তো কাহিনী সম্বলিত হয় এবং বিভিন্ন আনন্দ অনুষ্ঠানে প্রদর্শিত হয়। বিখ্যাত শিল্পী রাধারমন দত্ত কর্তৃক এই গান সর্বাধিক প্রচারিত হওয়ায় তাকেই ধামাইলের জনক বলে অভিহিত করা হয়।
ঝুমুর - বাংলার আর এক বিখ্যাত লোকগান এবং তার সাথে লোকনৃত্য হলে ঝুমুর। ঝুমুর গান মূলত পশ্চিমবঙ্গ ঝাড়খন্ড এবং উড়িষ্যার সাঁওতাল আদিবাসীদের মধ্যে ব্যাপকভাবে লক্ষ্য করা যায়। যদিও বর্তমানে ঝুমুরের ব্যপ্তি সারা পৃথিবী জুড়ে ছড়িয়ে গেছে। বলা হয় ঝুমুর গানের সঙ্গে কীর্তন জুড়েই যাত্রাপালা সৃষ্টি হয়েছিল। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং কাজী নজরুল ইসলাম ঝুমুর গানের আঙ্গিকে অনেক সুর রচনা করেছিলেন।
বৌ নাচ - বিয়ের পর শ্বশুর বাড়ি আসা নতুন বউকে নিয়ে এই নাচ অনুষ্ঠিত হয়। এই নাচের প্রধান বৈশিষ্ট্য হল নতুন বউকে মাটির সঙ্গে পা ঘেঁষে ঘেঁষে নাচতে হয়। আর বাকি রাও সেই সুরে বউকে কেন্দ্র করে নাচতে থাকে।
বহুরূপী - গ্রাম বাংলার এক আদি এবং অকৃত্রিম লোকগান তথা লোকশিল্প হলো বহুরূপী। বাংলার বিভিন্ন প্রান্তে শিল্পীরা বিভিন্ন সাজে সজ্জিত হয়ে নির্দিষ্ট ছড়া বা গানের মাধ্যমে সকলকে মনোরঞ্জন করতেন। বহুরূপীর বৈশিষ্ট্য হল বিভিন্ন ধরনের সাজ। সেখানে পুরাণ এবং ইতিহাস কেন্দ্রিক বিভিন্ন সাহায্যে যেমন থাকতো, ঠিক তেমনভাবে থাকতো রংমাখা হরবোলার সাজ৷ বহুরূপীর গান এবং ছড়াগুলি একটি নির্দিষ্ট ছন্দে এবং লয়ে আবৃত্তি করা হত।
ভাওয়াইয়া - ভাওয়াইয়া গানের প্রচলন মূলত বাংলাদেশের রংপুর, পশ্চিমবঙ্গের কোচবিহার এবং আসামের কিছু অংশে বহুল পরিমাণে দেখা যায়। এই গানের মূল বৈশিষ্ট্য হল স্থানীয় অঞ্চলের মানুষজনের দৈনন্দিন জীবনযাত্রা এবং পারিবারিক ঘটনাবলীর কথা গানে গানে তুলে আনা। কথায় বলে যে গানের মধ্যে দিয়ে মনের ভাব প্রকাশ পায় তাকেই ভাওয়াইয়া বলা হয়। বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলে নদী নালা কম থাকায় গরুর গাড়ির প্রচলন খুব বেশি। আরে গরুর গাড়ির চালকদের দ্বারা গীত সংগীত হিসাবে ভাওয়াইয়া প্রচলন। গরুর গাড়ির চাকা গরতে বললে যেমন সুর ভাঁজ হয়ে যায়, ভাওয়াইয়া গানেও তেমন ভাঁজ দেখা যায়।
গম্ভীরা - গম্ভীরা হল অন্যতম আরেকটি লোকগানের নাম। এই লোকগান সাধারণত পশ্চিমবঙ্গের মালদহ জেলায় প্রচুর পরিমাণে শোনা যায়। তাই পশ্চিমবঙ্গের মালদহ জেলা এবং বাংলাদেশের চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলায় এই গানের প্রচলন আছে। সাধারণত দলবদ্ধভাবে গম্ভীরা গান গাওয়া হয়। এটি একটি বর্ণনামূলক গান। অর্থাৎ কোন ঘটনাকে কেন্দ্র করে তার বিশদে বর্ণ নাই গম্ভীরা গানের বৈশিষ্ট্য।
কীর্তন - রাঢ় বাংলার লোকসংগীতে এক অন্যতম ধারা হলো কীর্তন। সাধারণত কোন দেব বা দেবীকে উদ্দেশ্য করে স্তুতিসংগীতকে কীর্তন বলা হয়। কীর্তন বাংলার এক অতি প্রাচীন লোকসংগীত এর আধার। খোল বা করতাল সহযোগে এই ধরনের গানের পরিবেশন করা হয়। এককভাবে বা দলবদ্ধভাবে কীর্তন সংগীত পরিবেশন করার প্রচলন আছে এই বাংলায়।
🙏 ধন্যবাদ 🙏
(১০% বেনিফিশিয়ারি প্রিয় লাজুক খ্যাঁককে)
--লেখক পরিচিতি--
কৌশিক চক্রবর্ত্তী। নিবাস পশ্চিমবঙ্গের হুগলি জেলায়। পেশায় কারিগরি বিভাগের প্রশিক্ষক। নেশায় অক্ষরকর্মী। কলকাতায় লিটল ম্যাগাজিন আন্দোলনের সাথে দীর্ঘদিন যুক্ত৷ কলকাতা থেকে প্রকাশিত কবিতার আলো পত্রিকার প্রধান সম্পাদক। দুই বাংলার বিভিন্ন প্রথম সারির পত্রিকা ও দৈনিকে নিয়মিত প্রকাশ হয় কবিতা ও প্রবন্ধ। প্রকাশিত বই সাতটি৷ তার মধ্যে গবেষণামূলক বই 'ফ্রেডরিক্স নগরের অলিতে গলিতে', 'সাহেবি কলকাতা ও তৎকালীন ছড়া' জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে। সাহিত্যকর্মের জন্য আছে একাধিক পুরস্কার ও স্বীকৃতি। তার মধ্যে সুরজিত ও কবিতা ক্লাব সেরা কলমকার সম্মান,(২০১৮), কাব্যলোক ঋতুভিত্তিক কবিতায় প্রথম পুরস্কার (বাংলাদেশ), যুগসাগ্নিক সেরা কবি ১৪২৬, স্রোত তরুণ বঙ্গ প্রতিভা সম্মান (২০১৯), স্টোরিমিরর অথর অব দ্যা ইয়ার, ২০২১, কচিপাতা সাহিত্য সম্মান, ২০২১ তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য।
কমিউনিটি : আমার বাংলা ব্লগ
ধন্যবাদ জানাই আমার বাংলা ব্লগের সকল সদস্যবন্ধুদের৷ ভালো থাকুন, ভালো রাখুন।
Daily Tasks -
https://x.com/KausikChak1234/status/1869786362779709521?t=1gUV2ZT5vqGhACcNM9dDGg&s=19
Upvoted! Thank you for supporting witness @jswit.
অনেক সুন্দর একটি বিষয় নিয়ে আমাদের সাথে আলোচনা করেছেন ভাইয়া। টুকটাক গান করতে পছন্দ করি। তাই আপনার এই কথাগুলো বেশ ভালো লাগলো। যদিও এই বিষয়ে একদমই কোনো জ্ঞান ছিল না। ধন্যবাদ বাংলার লোকগান ও লোকনৃত্যের বিভিন্ন প্রকারভেদ নিয়ে আমাদের সাথে আলোচনা করার জন্য।
বাংলার লোকগান হলো বাংলার সম্পদ। কিন্তু আমরা ধীরে ধীরে সেই সম্পদের কথাই ভুলে যাচ্ছি। তাই ভাবলাম সেই বিষয়ে একটা পোস্ট করি। অনেক ধন্যবাদ আপনার ভালো লাগলো বলে।
জাস্ট দারুন পোস্ট। আমাদের গ্রামবাংলায় এই ফোক সং যেটাকে বলে বা পল্লীগীতি তার মাধুর্য এতই বেশি সেটা বলার অপেক্ষা রাখে না। তবে বর্তমান আধুনিকতার জোয়ারে বাকিগুলো সবই চাপা পড়ে যাচ্ছে এটা দুঃখের। এই সংগীত সংস্কৃতিই তো আমাদের মূল্যবান সম্পদ। ধরে রাখতে হবে। তোমার পোস্টটা পড়তে পড়তে ভাবছিলাম আহা যদি শান্তিনিকেতন যেতে পারতাম। ভীষণ ভালো বিষয়ে পোস্ট লিখেছো।
আমার পোস্ট পড়ে খুব সুন্দর একটি মন্তব্য করলি। চেষ্টা করেছি লোকগানের সবকটি দিক কভার করার। তবে আরও বিভিন্ন ধরনের লোকগান আমাদের বাংলায় শোনা যায়। ভালো লাগলো এত সুন্দর একটি মন্তব্য করলি বলে।
বাংলার এক এক ধরনের লোকগীতির এক এক ধরনের সুর, তাল এবং মূখ্য বিষয় ও একেক ধরনের। তবে প্রতিটি ধারাই মন ছুঁয়ে যায়! বাকি গুলোর সাথে পরিচয় থাকলেও বৌনাচ এর ব্যাপার টি আপনার পোষ্ট থেকেই জানলাম। দেখি এখন ইউটিউব এ গিয়ে সার্চ দিয়ে বিস্তারিত দেখার চেষ্টা করবো। অসংখ্য ধন্যবাদ আপনাকে এমন সুন্দর একটি প্রতিবেদন শেয়ার করার জন্য ।
আমার প্রতিবেদনটি আপনার ভালো লেগেছে শুনে আমার খুব ভালো লাগলো। চেষ্টা করেছি বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ লোকগানের অংশ এবং তার ব্যাখ্যা শেয়ার করতে। আসলে এই লোকগান আমার অতি প্রিয় একটি বিষয়। এত সুন্দর গুছিয়ে মন্তব্য করবার জন্য অনেক ধন্যবাদ বোন।