কলকাতার বাগবাজার অঞ্চলের নামকরণের ইতিহাস নিয়ে দু-চার কথা।

in আমার বাংলা ব্লগ8 days ago

বাগবাজার নামের উৎপত্তি ও ইতিহাস

💮💮💮💮💮💮💮💮💮


rowing-7410640_1280.jpg
সোর্স

🙏 সকলকে স্বাগত জানাই 🙏


তৈরি হল শহর কলকাতা। আর সেখানে বাজার থাকবে না তা কি করে হয়। সুতরাং বিভিন্ন দিকে তৈরি হল বাজার। যেমন শোভাবাজার, বাগবাজার, লালবাজার, শ্যামবাজার অথবা চিনাবাজার। প্রায় আড়াইশো বছর আগেও কলকাতায় ১৮ টি বাজারের অস্তিত্ব পাওয়া যায়। আর সেইসব বাজার থেকে কর সংগ্রহের দায়িত্ব ছিল কোম্পানির 'ব্ল্যাক জমিদার'এর হাতে। ঠিক যেমন সেই দায়িত্বে ছিলেন কুমোরটুলির গোবিন্দরাম মিত্র। তামাম কলকাতা শহরে তখন তাঁর জুড়ি পাওয়া দায়। আর তাঁর প্রতিপত্তির একটা প্রধান দিক ছিল বাজারগুলোর রমরমা আয় উপায়। বাংলার প্রথম ইউরোপীয় অতিথি হল পর্তুগীজরা। আজও গঙ্গার পাড় ঘেঁষে তাদের দস্যুবৃত্তি নিয়ে অনেক লোককাহিনী প্রচলিত আছে বাংলার ঘরে ঘরে। কিন্তু একসময় ডিহি কলকাতায় তারাই ছিল প্রথম ভিনদেশী। সেই সময়ই সুতানুটি অঞ্চলে বেশ বড় একটা হাট বসতো। পর্তুগীজরাও সেখানে কেনাকাটি করতে আসত নিয়ম করে। বাংলার বিখ্যাত মসলিন, রেশম, নুন আর মশলা ঘিরে একটা জমজমাট ব্যবসার পরিবেশ গড়ে উঠতে শুরু করে সেইসময় থেকেই। পর্তুগীজরাও বাংলার জিনিস ইউরোপে চালান করে মোটা টাকার লাভ করতে থাকে। এরপর একে একে ডাচ, ড্যানিশ, ফরাসী, ইংরেজদের বাংলায় আগমন। নবাবী ফরমান নিয়ে জমিয়ে শুরু হয় তাদের রপ্তানি কেন্দ্রীক ব্যবসা বাণিজ্য। আর তার সাথে সাথেই তরতরিয়ে বেড়ে উঠতে শুরু করে কলকাতার হাট। দেশীয় মানুষেরাও পণ্য সাজিয়ে পৌঁছে দিতে শুরু করে বিদেশী বেনিয়াদের কাছে। এইসব বাজারের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল বাগবাজার। বিখ্যাত কথাকবি রূপচাঁদ পক্ষী ছড়া কেটে গান ধরলেন -

বাগবাজার কলিবাজার
বাজারে বাজারে একাকার
এত বাজার দোকানদার
কোন রাজ্যে নেই কার।

বাগবাজার নামকরণ নিয়ে আছে বিভিন্ন মত। আজ আমরা সকলেই প্রায় জানি বাগবাজারে ভাগীরথী এক বিশাল বাঁক তৈরি করে বয়ে গেছে কলকাতা শহরের বুক চিরে। আর সেই বেঁকে যাওয়া নদীর তীরেই সেকালে বসত জমজমাট বাজার। সেখান থেকেই বাঁকবাজার হয়ে বাগবাজার। আবার ভিন্নমতে শোনা যায় আজ যেখানে বাগবাজার সার্বজনীন দুর্গাপুজোয় মেতে ওঠে আপামর বাঙালী, একসময়ে সেখানেই ছিল পেরিন সাহেবের এক মস্ত বাগান। ফার্সীতে বাগানকে বলে বাগ। আর সেখান থেকেই আজকের বাগবাজার। পরে কম টানাপোড়েন হয়নি সেই বাগান নিয়ে। বিভিন্ন হাত ঘুরে পেরিন সাহেবের হাত থেকে বাগানটি আসে ফোর্ট উইলিয়ামের কর্মাধ্যক্ষ জেফানিয়া হলওয়েল সাহেবের হাতে ও পরে ওয়ারেন হেস্টিংএর শ্বশুরমশাই স্কট সাহেবের হাতে। নবাব সিরাজদ্দৌলা যখন কোম্পানিকে শায়েস্তা করতে সৈন্যসামন্ত নিয়ে কলকাতা আক্রমণ করলেন, তখন এই হলওয়েল সাহেবই কয়েকজন বিশ্বস্ত অফিসার ও সিভিলিয়ান সমেত লুকিয়ে ছিলেন ফোর্ট উইলিয়ামের গুপ্তঘরে।

সে যাই হোক, ঠিক যেভাবে রোজ পাল্লা দিয়ে বাড়তে থাকলো কলকাতার জনসংখ্যা, সেভাবেই খুব তাড়াতাড়ি বেড়ে উঠতে শুরু করলো বাজারগুলোর পরিধিও। আবার কালের চাকায় হারিয়েও গেল কিছু বাজার। যেমন খাসবাজার। পুরনো কলকাতার এই বাজারটির আর কোনো অস্তিত্ব নেই। এদিকে বাগবাজারে গঙ্গার ধারে বিশাল বিকিকিনির হাট দেখে মুখে মুখে তৈরি হল ছড়া।

ময়রা মুদি কলাকার
তিন নিয়ে বাগবাজার

আসলে কী নেই এই বাগবাজারে। বিখ্যাত কবিগানের ওস্তাদ হরু ঠাকুরের শিষ্য দিগ্বিজয়ী কবিগায়ক ভোলা ময়রার মিষ্টির দোকানও ছিল এখানেই। তিনি মুখে মুখে বলতেন -

আমি ময়রা ভোলা হরুর চেলা বাগবাজারে রই...

আবার রসগোল্লার কমম্বাস নবীনচন্দ্র দাসের বাসও এখানেই। তাঁর নাতি কৃষ্ণচন্দ্র দাস বা কে সি দাস আজও সারা পৃথিবীকে রসগোল্লার স্বাদ আস্বাদন করিয়ে চলেছেন। রূপচাঁদ পক্ষীর নেতৃত্বে পক্ষীর গানের দলের আখড়াও ছিল এই বাগবাজারেই। টপ্পা বা বৈঠকীগানের কিংবদন্তি ওস্তাদ নিধুবাবুও নিয়মিত আসতেন সেখানে। সুতরাং কী নেই সেখানে। যেন কলকাতার মধ্যেই আরো একটি ছোট্ট কলকাতা। সমস্ত পুরাতনী লোককথা বুকে নিয়ে আজও দাঁড়িয়ে আছে আধুনিক পাল্টে যাওয়া বাগবাজার। সেখানেই মিত্র পরিবারে আজও পূজিত হন মদনমোহন জিউ। বিষ্ণুপুরের রাজা চৈতন্য সিংহের হাত ধরে যে মদনমোহন কলকাতাবাসী হয়েছিলেন, তিনি আজও সেবিত হন বাগবাজারেই। এখানেই আজও দাঁড়িয়ে আছে পুরনো কলকাতার প্রাচীন শ্মশান কাশী মিত্র ঘাট। নবাব সিরাজদ্দৌলার সময়কালীন ঢাকার রাজা রাজবল্লভ মিত্রের ভাইপো কাশী মিত্রও থাকতেন বাগবাজারেই। আর তাঁর নামেই নামাঙ্কিত এই শ্মশান ঘাট। শহরের আধুনিক মোড়কটুকু সরিয়ে একটু পুরনো ঘাট বা রোয়াকগুলোতে বসলে এভাবেই যেন আজও বেরিয়ে আসে এক পুরনো ও হারিয়ে যাওয়া কলকাতা শহর।


🙏 ধন্যবাদ 🙏


(১০% বেনিফিশিয়ারি প্রিয় লাজুক খ্যাঁককে)



1720541518267-removebg-preview.png

Onulipi_07_27_10_21_22.jpg


Yellow Modern Cryptocurrency Instagram Post_20240905_213048_0000.png

new.gif

1720541518267-removebg-preview.png


--লেখক পরিচিতি--

IMG_20240303_181107_644.jpg

কৌশিক চক্রবর্ত্তী। নিবাস পশ্চিমবঙ্গের হুগলি জেলায়। পেশায় কারিগরি বিভাগের প্রশিক্ষক। নেশায় অক্ষরকর্মী। কলকাতায় লিটল ম্যাগাজিন আন্দোলনের সাথে দীর্ঘদিন যুক্ত৷ কলকাতা থেকে প্রকাশিত কবিতার আলো পত্রিকার প্রধান সম্পাদক। দুই বাংলার বিভিন্ন প্রথম সারির পত্রিকা ও দৈনিকে নিয়মিত প্রকাশ হয় কবিতা ও প্রবন্ধ। প্রকাশিত বই সাতটি৷ তার মধ্যে গবেষণামূলক বই 'ফ্রেডরিক্স নগরের অলিতে গলিতে', 'সাহেবি কলকাতা ও তৎকালীন ছড়া' জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে। সাহিত্যকর্মের জন্য আছে একাধিক পুরস্কার ও স্বীকৃতি। তার মধ্যে সুরজিত ও কবিতা ক্লাব সেরা কলমকার সম্মান,(২০১৮), কাব্যলোক ঋতুভিত্তিক কবিতায় প্রথম পুরস্কার (বাংলাদেশ), যুগসাগ্নিক সেরা কবি ১৪২৬, স্রোত তরুণ বঙ্গ প্রতিভা সম্মান (২০১৯), স্টোরিমিরর অথর অব দ্যা ইয়ার, ২০২১, কচিপাতা সাহিত্য সম্মান, ২০২১ তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য।



কমিউনিটি : আমার বাংলা ব্লগ

ধন্যবাদ জানাই আমার বাংলা ব্লগের সকল সদস্যবন্ধুদের৷ ভালো থাকুন, ভালো রাখুন।

Drawing_11.png

44902cc6212c4d5b.png

First_Memecoin_On_Steemit_Platform.png

hjh.png


Sort:  
 8 days ago 

Daily Tasks-

Screenshot_20241226-210603.jpgScreenshot_20241226-210216.jpgScreenshot_20241226-210148.jpgScreenshot_20241226-210020.jpg

Upvoted! Thank you for supporting witness @jswit.