আমার ছোটবেলায় ঘটে যাওয়া একটি ঘটনা - "পদ্ম গোখরো-র তাড়া খাওয়া"

in আমার বাংলা ব্লগ3 years ago (edited)


Copyright Free Iamge Source


আমার যে গ্রামে জন্ম সেটা এতই অজ-পাড়াগাঁ ছিল যে কি আর বলবো । বিদ্যুৎ ছিল না, কাঁচা রাস্তা আর ঝোপ-ঝাড় জঙ্গলে পরিপূর্ন ছিল । গ্রামটির নামও তার চেহারারই মানানসই । দিনের বেলাতেই, সাপ, বন বেড়াল, বেজী আর শেয়াল কত দেখেছি ! আর ছিল বড় বড় গোসাপের দল । এরা আপাত নিরীহ হলেও সময়ে সময়ে ভয়ঙ্কর হয়ে উঠতো । ছোট ছেলেমেয়েদেরকে তাড়া করতো । শেয়ালের কামড় আর সাপের কামড় খাওয়াও খুব একটা বিরল ঘটনা ছিল না ।

আমার মনে আছে ছোটবেলায় সন্ধ্যের পর বাড়ির থেকে বেরোনো নিষেধ ছিল শুধুমাত্র শেয়াল আর সাপের কারণে । আমার মা তার বিয়ের পর এই গ্রামে এসে সাপের উপদ্রব দেখে ভয়ে জ্ঞান হারিয়ে ফেলার মতো অবস্থা হয়ে ছিল । ভাগ্যকে ধন্যবাদ যে আমাদের ফ্যামিলির কাউকেই কোনোদিন সাপে কাটেনি । কিন্তু, অনেকগুলি ভয়াবহ ঘটনার সম্মুখীন হয়েছিল আমাদের ফ্যামিলির অনেকেই । তার মধ্যে আমিও একজন আছি ।

আমাদের ফ্যামিলির আদি নিবাস এই গ্রামে ছিল না । পূর্ববঙ্গের অন্য একটি গ্রামে ছিল, বহুকাল আগে সেখানে আমাদের এক পূর্বপুরুষ এক জমিদারের নায়েব সরকারের চাকরি করতেন । যতদূর জানা কথা বেশ অত্যাচারী ছিলেন তিনি । প্রজাদের উপরে খাজনা আদায়ে বেশ কড়া ছিলেন । প্রভূত সম্পত্তির মালিক হওয়া সত্ত্বেও তার পাপের ফল তিনি পেয়ে গিয়েছিলেন । হাজার বিঘে জমি হারানো, বংশধরদের বাড়িতে অজস্রবার ডাকাতি হওয়া, আগুন লেগে বসতবাটীর পুরোটাই ভস্মীভূত হয়ে যাওয়া, এসব তো ছিলই । কিন্তু, সব চাইতে বেদনাদায়ক ব্যাপার ছিল যেটি সেটি একটু বলি । এরপরে আমার সাপে তাড়া খাওয়ার গল্পটি করবো ।

আমার সেই পূর্বপুরুষের পুত্রবধূ । মাঝবয়সী । তাঁর অভ্যাস ছিল প্রত্যহ সন্ধ্যায় নদীর ঘাটে গা ধুতে যাওয়া । সময়টা বর্ষার মাঝামাঝি । নদীতে তখন ভরা বর্ষার বান ডেকেছে । এই সময়টাতে গ্রামের মানুষ পুকুর বা দীঘিতেই স্নান সারে, কারণ পরে বলছি । সেদিন ঢেঁকি ঘরে ধান কোটার কাজ তদারকি করতে করতে বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যে । ঠাকরুন স্নানে যাবেনই যাবেন । সকলের অজস্র নিষেধ অমান্য করে তিনি এসে দাঁড়ালেন বাড়ির পিছনদিকে প্রবাহিত সেই ছোট্ট নদীর ঘাটে । ঘাটের সিঁড়িতে এক ঝি-কে গামছা, তেল আর সিঁদুর দিয়ে বসিয়ে রেখে ঠাকরুন ঘাটের পৈঠা বেয়ে জলে নামলেন ।

সামান্য কিছু মুহূর্ত । জলে হঠাৎ একটা ভীষণ আলোড়ন উঠলো । বিশাল একটি কালো অবয়ব আবছা দেখা গেলো । তার দুই রাক্ষুসে বিশাল চোয়ালের ফাঁকে ঠাকরুনের শরীরটা ছটফট করছে । পরক্ষনেই জলের অতলে ডুব দিলো সেই রাক্ষস । ঝি চিৎকার করে ছুটতে ছুটতে বাড়িতে এসে আছাড়ি পিছাড়ি খেয়ে পড়লো ।

কুমীর । লোনা জলের ভয়ঙ্কর দানব । শিকার ধরার আশায় ঘাটের কাছেই ওঁৎ পেতে ছিল । ঠাকরুন জলে নামার মুহূর্তে আক্রমন করে তাঁকে শিকারে পরিণত করে । লণ্ঠন আর প্রচুর লোকজন নিয়ে সবাই ঘাটের কাছে এলো । কোথাও কিছু নেই । নিস্তব্ধ চারিদিক । নদীর জলের কোথাও রক্তের লেশমাত্র নেই । থাকার কথাও নয়, যে স্রোত !

না, আর কোনোদিনও ঠাকরুনের খোঁজ মেলেনি । সেই ঠাকরুনের ছেলের ছেলে হলো আমার ঠাকুরদা, অর্থাৎ আমার বাবার বাবার বাবার বাবা হলো ওই ঠাকরুনের ছেলে । এই করুন ইতিহাস আমি ছোটবেলায় বহুবার শুনেছি ।

এবার আসা যাক আমার ঘটনায় । সাপের ছোটবড় বেশ কয়েকটি ঘটনা ঘটেছিলো আমার ছোটবেলায় । খুব বেশিদিন গ্রামে থাকিনি তো । কে জানি আরো বেশি কিছুদিন থাকলে এতদিনে ছবি হয়ে যেতাম কি না । যাই হোক স্মৃতি থেকে দুটি মাত্র ঘটনার উল্লেখ করবো আমি ।

কৃষ্ণা চতুর্দশীর রাত সেদিন । শ্রাবণ মাসের সবে শুরু । আমাদের বাড়িতে অনেক গুলি ঘর ছিল আগেই বলেছি একদিন । মোট ১১ খানা ছোট বড় মিলিয়ে ঘর ছিল । তো সেদিন আমি আমার মেজ জেঠুর ভেতর বাড়ির এক ঘরে শুয়েছিলাম । অনেক রাত্তির পর্যন্ত জেঠতুতো দিদিদের সাথে লুডু খেলে আর আমাদের ঘরে যাইনি । ওখানেই একটা খাটে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম । ছোট মানুষ, খাটের এক কোনায় দিব্যি জায়গা হয়ে গিয়েছিলো ।

তো মাঝ রাত্তিরে আমার হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেলো । হিসু পেয়েছে । গ্রামে যখন থাকতাম তখন মাঝরাত্তিরে প্রস্রাবের জন্য মা'কে ঘুম থেকে ডেকে তুলে তারপরে বাইরে গিয়ে প্রস্রাব করতাম । পুরোটাই ঘুম চোখে , প্রায় চোখ বুজে । তো সেদিন ঘুম ভেঙে প্রথমে কিছুক্ষন মাথাটা ভোম্বল হয়ে থাকলো । কোথায় আমি, তাই মনে করার প্রানপন চেষ্টা করছি ।

এমন সময় একটা অদ্ভুত হিস্ হিস্ শব্দ শুনতে পেলাম । মনে হচ্ছে কেউ যেনো হুইসলে ফুঁ দিচ্ছে প্রানপনে কিন্তু শুধু তীব্র হিস্ হিস্ শব্দ হচ্ছে । প্রেশার কুকারে সিটি দেয়ার মতো । তবে শব্দের তীব্রতা অনেক বেশি । হিস্ হিস্ শব্দের সাথে তীব্র ফোঁসফোঁসানি প্রায় গর্জনের মতো । শুয়ে শুয়ে অনেক্ষন শুনলাম । কিন্তু কিছুই বুঝতে পারলাম না ।

এবার মশারি সরিয়ে মেঝেতে এক পা দিলাম । নামবো । হিসু না করলেই নয় । দু'বার মৃদুস্বরে মা মা করে ডাকলাম । তখন, হঠাৎ খেয়াল হলো আমি জেঠুর ঘরে । মা'কে কোথায় পাবো । আবার পা তুলে নিলাম । আজ এতো বছর পরে মনে পড়লে এখনো গাঁ শিউরে ওঠে । ঈশ্বরকে ধন্যবাদ সেদিন পা তুলে নিয়েছিলাম ।

আমার ডাক শুনে আমার এক জেঠতুতো দিদির ঘুম ভেঙে যায় । সে সেই তীব্র ফোঁসফোঁসানি আর হিস্ হিস্ গর্জন শুনে মশারি সরিয়ে মেঝেতে টর্চের আলো ফেললো । সে মুহূর্তে আমরা দু'জনেই ভয়ে একদম পাথর । আমার পিঠ দিয়ে ভয়ের একটা শীতল স্রোত নেমে গেলো । মাটির মেঝে । আর সেই মেঝেতে একটি চলমান মেটে কালো ধূসর বর্ণের সরীসৃপ । মেঝে থেকে প্রায় ১ হাত উঁচু ফণা তুলে তীব্র রাগে ঘরের এ মাথা থেকে ও মাথা পর্যন্ত কাউকে তাড়া করে চলেছে । বিশাল একটি পদ্ম গোখরো, কেউ কেউ বলে খৈয়া কেউটে । সাক্ষাৎ মৃত্যু দূত ।

তীব্র বিষ এই কেউটের । এক ছোবলেই একদম ছবি । আমার দিদি যেভাবে বাড়ি মাথায় করে চিল চিৎকার দিলো আমি ভাবলাম তাকেই বুঝি কামড়ে দিয়েছে । তার চিৎকারে বাড়িসুদ্ধ সবাই জেগে উঠলো । সবাই টর্চ নিয়ে দৌড়ে এলো । এত লোকের তাড়া খেয়ে সাপটি একটি ইঁদুরের গর্তে ঢুকে পড়লো ।

আসলে, হয়েছে কি সন্ধ্যের পর কোনো এক সময় সাপটি ঘরে ঢুকেছে ইঁদুরের লোভে । ওই ইঁদুরের গর্তেই সে আশ্রয় নিয়েছিল । মাঝ রাত্তিরে ঘরে হঠাৎ ছুঁচো ঢুকলে সে ছুঁচো তাড়া করছিলো । আর ধরতে না পেরে নিষ্ফল ক্রোধে অমন তর্জন গর্জন করছিলো ।

সাপের গর্ত আবিষ্কার হলো । ব্যাঙ বড়শিতে গেঁথে গর্তের মুখে দিয়ে সাপ টেনে বের করে পিটিয়ে মারলো সবাই । পরে, আগুনে পুড়িয়ে ফেলতে ফেলতে ভোর হয়ে গিয়েছিলো ।আমি অবশ্য সে সব দৃশ্য উপভোগ করা থেকে বঞ্চিত হয়েছিলাম । কারণ, মা আমাকে আমাদের ঘরে নিয়ে যায় প্রায় সঙ্গে সঙ্গে । আর ওদিক পানে যেতে দেয়নি । পরে সকাল হলে, আমার জেঠতুতো-কাকাতো ভাই বোনেদের মুখে গত কালরাত্রির বাকি ঘটনাটুকু শুনে ছিলুম ।

মনে আছে, এই ঘটনার পর থেকে আমার সমবয়সীদের কাছে আমি রীতিমত হিংসার পাত্র বনে গিয়েছিলাম, এমন রোমাঞ্চকর ঘটনা আমার সাথে ঘটার জন্য । অনেক দিন আগের কথা । কিন্তু এখনো শিউরে উঠি সেদিন রাতের কথা মনে পড়লে ।


Sort:  

Nice

@godlovermel25 Fuck off your fucking trash comment! You are shitty fucking asshole motherfucker 🖕

Thank You for sharing Your insights...

জীবন,যার প্রতিক্ষন
একটি ঘটনা।
কেউ রটায়,
কেউবা রটায় না।

হিসহিসানী ফিসফিসানি
পরে বুঝলেন সাপ,
টর্চের আলোয়
চিল্লান দিয়ে বললেন বাপরে বাপ।

এতদিন পর রটিয়ে দিলেন
আমাদের তরে,
গল্পের মত মনে হলো
উপস্থাপনার কারনে।

 3 years ago 

ঠাকরুনের কাহিনী পড়ে আমি খুবই মর্মাহত সত্যি কথা বলতে পরিবারের জ্যেষ্ঠদের নিশাত থাকা সত্ত্বেও যখন আমরা কোনো কাজ করতে চাই তখন একটু বিপদ আমাদের সাথে হানা দেয় কিন্তু ঠাকরুনের সাথে যে বিপদ এসেছিল তা একটি পরিবারকে একটি সন্তানকে মারা হয়েছিল তা অত্যন্ত বেদনাদায়ক বলে মনে করছি।

দাদা পদ্মগোখরা অসম্ভব বিষধর সাপ আমি শুনেছিলাম এই সাপে একটি ছবি নাকি হাতির হাড় নাকি গলে যায় যায়। কিন্তু আপনি এই বিপদ থেকে বেঁচে আছেন এজন্য মহান সৃষ্টিকর্তার কাছে শুকরিয়া। আপনার সাপের গল্পটি শুনে আমারই গা ঝিমঝিম করছে ভয়ে । আমি হলে তো ওখানে অজ্ঞান হয়ে পড়ে যেতাম। এত সুন্দর একটি লোমহর্ষক কাহিনী আমাদের সাথে তুলে ধরার জন্য আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ।

Thank You for sharing...

 3 years ago (edited)

দাদা আপনার গল্প পড়তে গিয়ে আমার পিছনের অতীতের কথা অর্থাৎ সাপ নিয়ে আমার ভয়ের গল্প মনে পড়ে গেল।একবার আমি পুকুর থেকে কলসি ভরাট করে পানি আনতেছিলাম আমাদের দুপুরবেলা রান্নার জন্য।আর আমি যখন আমার উঠান পর্যন্ত মাথা করে কলসটি আনলাম তখন নারকেল গাছের উপর থেকে একটা সাপ আমার মাথার উপর পড়ল। আর আমি কলস পেলে দিয়ে দৌঁড়ে গিয়ে আমার মায়ের কাছে গিয়ে পালালাম।সেই কি যে বিভীষিকা মুহূর্ত ছিলো আমার দাদা।
তবে আপনার গল্পটা শুনেও আমার গা শিহরিত হয়ে উঠলো।
ধন্যবাদ দাদা আপনার গল্প পড়তে গিয়ে আমার ও সাপ নিয়ে যে একটা ইতিহাস বা ভয়ের গল্প ছিল তা মনে পড়ে গেল।

Thank You for sharing...

 3 years ago 

লেখাটা পড়তে নিয়ে ভয়ে গা শিউরে উঠল দাদা । কপাল ভালো যে কোনো ক্ষতি হয়নি কারোর। ছোটবেলায় আমি যখন গ্রামে থাকতাম আমার সাথে এরকম দুই একটা ঘটনা ঘটেছিল। এই সরিসৃপ প্রানী টিকে ভীষণ ভয় পাই আমি। লেখাটা পড়ে ভেতরে খুব ভয় ভয় লাগছে সত্যি।

 3 years ago 

দাদা আপনার ছোট বেলার গল্প পড়তে পড়তে আমি কোথায় জানি হারিয়ে গিয়েছিলাম। মনে হচ্ছিল আমি আপনারদের বাড়ী টি দেখতে পাচ্ছি কল্পনায়। এত সুন্দর সহজ সরল ভাষায় লিখেছেন খুবি ভাল লাগলো। আমাদের ঘড়েও একটা সরীসৃপ ঢুকেছিল তবে সেটা কি ধরনের তা জানি না। সেও ইদুরের গর্তে ঢুকে ছিল। আমি তাকে সাবল দিয়ে খুচিয়ে বের করে টুকরো টুকরো করেছিলাম। ভাল লাগলো দাদা এভাবে শেয়ার করবেন আপনার ছোট বেলার গল্প গুলো। শুভেচ্ছা।

 3 years ago 

ভাগ্যিস মশারি ভিতর থেকে নেমে পড়েন নি ভাই । ও মাই গড , কি একটা অবস্থা । ভাবতেই গা শিরশির করছে । খুব কাছ থেকে বেঁচে গেছেন ভাই । তাছাড়াও ঠাকুরুনের ব্যাপারটাও বেশ ভয়ের ছিল ভাই ।

 3 years ago 

দাদা ভয়ানক একটি সত্য গল্প শুনে ভয়ে আমার গা শিউরে উঠেছে। সাপ নামক এই প্রাণীটাকে আমি অত্যন্ত ভয় পাই। দূরে থেকে বাঘ দেখলে আমার ভয় লাগে না কিন্তু সাপ দেখলে আমার গা শিরশির করে ওঠে। লেখাটি পড়ে বুঝতে পারলাম যে আপনি ছোট বেলায় অনেক বড় বিপদ থেকে বেঁচে গিয়েছেন। সেরাতে আপনি বিছানা থেকে পা নামিয়ে না উঠালে যা বিপদ হওয়ার হয়ে যেত। আপনার ছোটবেলার লোমহর্ষক এই ঘটনাটি আমাদের মাঝে শেয়ার করার জন্য অসংখ্য ধন্যবাদ।

Thank You for sharing...