ধর্মান্ধতা ও মনুষ্যত্ব

in আমার বাংলা ব্লগ2 years ago


Copyright Free Image Source: Pixabay


না, এটা কোনো প্রবন্ধ না । এই লেখাটি না কোনো উপদেশমূলক, না কোনো ধর্মীয় পোস্ট । এটি নিছকই একটি গল্প । আমার নিজের জীবনের একটি টুকরো ঘটনা । ছোটবেলাকার । গ্রামে থাকতাম তখন । আমার মায়ের এক কাকীমা ছিল । আমাদের ছোট দিদিমা । বুড়ি ভয়ানক সাধু ছিল । গোঁড়া হিন্দু যাকে বলে । গলায় অষ্টপ্রহর তুলসীমালা, কপালে, নাকে, গলায়, বাহুতে, কোমরে, পিঠে সর্বত্র তিলক আঁকা । নিরামিষ স্বপাক আহার আর প্রায় সারাক্ষনই পুজো-আচ্চা নিয়ে থাকা । এই ছিল ছোটদিদার একমাত্র রুটিন ।

বৈষ্ণব ধর্মমতে দীক্ষা নিয়েছিলেন উনি এক সাধুর কাছ থেকে । সারাক্ষন, তাই রাধে-কেষ্ট, রাধে-কেষ্ট করতো । ভয়ানক ছোঁয়াছুঁয়ি ছিল বুড়ির । মামাবাড়ি গেলে স্নান না করে তাঁকে স্পর্শ করা যেত না । মাছ, মাংস খেয়ে এসে ছোঁয়া অসম্ভব ছিল তাঁকে । তাঁর কাছে প্রায় দুনিয়াসুদ্ধ সব কিছুই অশৌচ ছিল । শুধু আমরা বাদে । আমরা নাতিদের একটু বকাবকি করলেও সব কিছুই এলাউ করতো ।

তো, মামাবাড়িতে আমি একটা কুকুর পুষেছিলাম । আমার জীবনে প্রথম পোষা কুকুর ছিল এটিই । আমি যতদিন থাকতাম বেশ আদর যত্ন করতাম কুকুরটার । চলে আসার সময়ে দিদিমাকে বার বার বলে দিয়ে আসতাম যেন ভুলুর যত্ন আত্তি ঠিকঠাক হয় ।

মামাবাড়িতে এই কুকুর পোষা বড় সহজ কাজ ছিল না কিন্তু । একটা রাজ্য জয় করার মতোই কঠিন কাজ এটি । ছোটদিদিমার জন্য মামাবাড়িতে জীবনেও কুকুর পোষা হয়নি । কুকুর অতি অপবিত্র জীব । তাঁর যুক্তি ছিল যে বাড়িতে রাধা-গোবিন্দের মূর্তি আছে সে বাড়িতে কুকুর ঢোকা নিষিদ্ধ ।

আমার এই কুকুর পোষাকে কেন্দ্র করে বিশাল সমস্যা হয়েছিল । কোনোভাবেই ছোটদিদা দেবে না বাড়িতে কুকুর ঢুকাতে । আর আমিও জেদ ধরে বসে থাকলাম । কুকুর পুষবই পুষবো । শেষমেষ আমার জিদেরই জয় হলো । কিন্তু, রাগে ছোটদিদা দুই দিন আমাদের কারো সাথে কথা বলেনি ।

কুকুরকে সর্বদা মূল বাড়ির থেকে কিছুটা দূরেই রাখা হতো বেঁধে । মাঝে মাঝে বাঁধন খুলে দেয়া হতো । কিন্তু, মূল বাড়ির উঠোন অব্দি ছিল তার যাওয়ার সর্বশেষ ঠিকানা । ছোটবেলা থেকে এই শাসনে ভুলু দুটি জিনিস খুব ভালো করে বুঝে গেলো । এক. বাড়ির ভেতরে কোনোদিনও প্রবেশ করা যাবে না আর দুই. ছোটদিদাকে দেখলেই ছুটে বাড়ির দক্ষিণ কোণে বাগানের মধ্যে লুকিয়ে যেতে হবে ।

কারণ, ভুলুকে দেখলেই ছোটদিদা রাগে অন্ধ হয়ে যেত । কুকুরের মতো এত নিকৃষ্ট একটি জীবের ছায়া মাড়াতেও তাঁর তীব্র ঘৃণা বোধ হতো ।

এভাবেই কেটে গেলো দুটি বছর । ভুলু এখন পূর্ণবয়স্ক একটি কুকুর । তাঁর ঘুমানোর স্থায়ী ঠিকানা হলো রান্না ঘরের পাশে একটি কাঠকুটো রাখার জায়গায় । শীতকালে ওখানে বিছানা করে দেয়া হতো । বৃষ্টি পড়লেও ওখানেই গিয়ে আশ্রয় নিতো । বেশ উঁচু জায়গা, জল উঠতো না ।

একবার পুজোর ছুটিতে মামাবাড়ি গিয়েছি । ভুলু আমায় পেয়ে মহা খুশি । সেবার কিন্তু আবহাওয়া মোটেই ভালো ছিল না । বৃষ্টি বাদলা বেজায় । অষ্টমীর দিন ভোর থেকে তুমুল বৃষ্টি শুরু হলো । ঘরবন্দী হয়ে পড়লাম সবাই । সারাদিন ধরে বৃষ্টি হলো । কখনো ঝিরঝিরে, কখনো মুষলধারে ।

বিকেলবেলার পর থেকে বাতাসের তীব্রতা ভয়ানক বেড়ে গেলো । ঘন ঘন বজ্রপাত । আর সেই সাথে তুমুল বৃষ্টি । সন্ধ্যের কিছুটা আগে বাতাসের তীব্রতা বেড়ে ঝড়ের আকার নিলো । আমরা সবাই বারান্দায় খাটের উপরে বসে ঝড় দেখছি এমন সময় কুঁই কুঁই আওয়াজ ।

আর কে ? ভুলু । কখন জানি সিঁড়ি বেয়ে বারান্দায় উঠে এসেছে । বেচারার সারা গা ভেজা । থর থর করে কাঁপছে । ওকে দেখেই আমাদের মনে আতঙ্কের সঞ্চার হলো । এখুনি ছোটদিদা আসবে সন্ধ্যা প্রদীপ জ্বেলে । এসে যদি দেখে ভুলু ঘরে উঠে গিয়েছে তাহলেই হয়েছে আর কি !

আজকে সবার দফা রফা । কুকুর আমার । দায়িত্বও তাই আমার । ছুটে গিয়ে তাড়া দিলাম । নড়লো না । ধাক্কা দিয়ে বের করে দিতে গেলাম । এক বিন্দুও নড়াতে পারলাম না । সমানে কুঁই কুঁই করে যেতে লাগলো । মা ভয়ানক ঘাবড়ে গিয়ে দাদুর লাঠি বের করলো ।

এমন সময় ছোটদিদা চলে এলো । হাতে সদ্য প্রজ্বলিত সন্ধ্যা প্রদীপ । আমরা ভয়ে একেবারে চিত্রার্পিতের নিশ্চল হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম ।

আমাদের অবাক বিস্ময়মাখা দৃষ্টির সামনে ছোটদিদা এসে সন্ধ্যা প্রদীপ নিয়ে একটু আরতি করে সেটাকে মাটিতে নামিয়ে আস্তে আস্তে ভুলুর সামনে গিয়ে দাঁড়ালো । আমাকে এক ধমক দিয়ে বললো - "থাক থাক, ওকে তাড়াসনে । এই ঝড় বাদলার রাতে ও কোথায় যাবে বেচারা ?" এই বলে, তার একটা বহু পুরোনো পরনের শাড়ি এনে ঢেকে দিলো ভুলুকে ।

আমরা সেদিন এক অবাক করা ঘটনার সাক্ষী হলাম । ধর্মান্ধতার পরাজয় মানবিকতার কাছে ।

Sort:  

The earnings this picture has is really worth it . It doesn't require betting or any form of game. ..

This post has been upvoted by @italygame witness curation trail


If you like our work and want to support us, please consider to approve our witness




CLICK HERE 👇

Come and visit Italy Community



Hello
My name is calton. I voted your post using steem-fanbase.com.

 2 years ago 

শেষে এসে ছোট দিদার এমন কাজ সত্যি ই খুব ভাল লাগল । সত্যি ই মানবতা সবার উপরে । ধন্যবাদ ভাইয়া ।

 2 years ago 

ভালো লাগলো গল্পটা পড়ে।আসলে সব সময় দেখতে দেখতে কেমন জানি অদ্ভুত মায়া কাজ করে।যাই হোক কুকুরের নাম টা বেশ সুন্দর। ধন্যবাদ

 2 years ago 

মনুষ্যত্বই বড় ধর্ম।

 2 years ago 

মানবতার জয় এভাবেই হোক সব সময়। আসলে কুকুর দেখে অনেকেই ভয়ে অথবা ঘৃণায় দূরে থাকতেই পছন্দ করে। যেমন আমি পোষা কিংবা পাড়ার যে কোন কুকুর দেখলে ১০০ হাত দূরে থাকার চেষ্টা করি। তবে কখনো আঘাত করিনা।

দাদার পোস্ট গুলো আমি পড়ি কমেন্ট করি এবং ভুলে যায়।
এবার ভুলু নামটা নোট করে রাখলাম। পরীক্ষায় কমন পড়তে পারে। 🙂

 2 years ago 

সবই তো মায়া, তাইনা দাদা! অনেকদিন বাড়িতে থাকার পর একটা মায়া পড়েই যায়। তাছাড়া কুকুররা গুলুগুলু চোখে তাকিয়ে থাকলে যেকোনো মানুষের হৃদয় গলে যাবে।

 2 years ago 

সত্যি দাদা শেষ অংশে এসে অপ্রত্যাশিতভাবে চোখের কোনে পানি চলে আসলো, কারন আপনি যেভাবে শুরুতে বর্ননা দিয়েছেন সে অনুযায়ী অন্য কিছুর প্রত্যাশা ছিলো, যা সাধারণত সব সময় হয়ে থাকে। কিন্তু সত্যিটা দারুণভাবে প্রকাশিত হলো এবং মানবতার জয় হলো, জয় হোক সর্বদা মানবতার। খুব ভালো লাগলো লেখাটি। ধন্যবাদ

আমি তো মনে করেছিলাম ছোটদিদা সেদিন কোন একটা ঘটনা ঘটিয়ে ফেলবে। আপনার বারোটা বাজাবে। যাক, ছোটদিদা ও তো মানুষ, তাই শেষ পর্যন্ত মানবতার কাছে হার মেনেছে জেনে খুবই ভালো লাগলো। জয় হোক মানবতার।

 2 years ago 

আমি ভেবেছিলাম এই বুঝি সর্বনাশ বাড়িতে আবার নতুন করে ঝগড়া হবে, কিন্তু শেষটা বেশ চমৎকার ছিল প্রাণীর প্রতি তার এত মায়া সত্যিই খুব আশ্চর্য্য ছিল। আমরা জানি কুকুর অপবিত্র কিন্তু তারপরেও সে একটি প্রাণী তারও অনুভূতি আছে।

Coin Marketplace

STEEM 0.28
TRX 0.13
JST 0.033
BTC 62875.13
ETH 3030.71
USDT 1.00
SBD 3.67