ছোটগল্প "রক্তঝরা অভিশপ্ত রাত" - ০১

in আমার বাংলা ব্লগ3 years ago

[ঐতিহাসিক সত্য ঘটনা অবলম্বনে নিচের গল্পটি রচনা করা হয়েছে । এর আগে একাধিক খ্যাতিমান লেখক এই রক্তজল করা সত্য ঘটনা অবলম্বন করে অনেক গুলি গল্প রচনা করে গিয়েছেন । তন্মধ্যে "সিংহ কবলিত যাত্রী ট্রেন", লেখক বীরু চট্টোপাধ্যায়, গল্পটির কিছু কিছু অংশ এখনো মনে আছে । খুব ছোটবেলায় শিশুসাথীর পূজাবার্ষিকীতে গল্পটি পড়েছিলুম।
তবে, আমার আজকের লেখাটি একেবারেই সত্য ঘটনা অবলম্বনে মৌলিক লেখা ]



কপিরাইট ফ্রী ইমেজ সোর্স : Pixabay


ফ্রিকা । অন্ধকারাছন্ন মহাদেশ তখন ব্রিটিশ রাজের আলোকবর্তিকার নিচে দীপ্তমান হচ্ছে একটু একটু করে । একদিকে যেমন দেশটি উন্নত হচ্ছে অন্যদিকে এর অধিবাসীদের স্বাধীনতা হরণ করা হচ্ছে দ্রুতগতিতে ।

অমানুষিক নির্যাতনের শিকার হচ্ছে দিন দিন আফ্রিকার আদিম সন্তানেরা । তাদেরই রক্ত আর ঘামের উপর গড়ে উঠছে ইংরেজ আর ফরাসীদের স্বপ্ন ইমারত । সাদা চামড়ার মানুষেরা কালো চামড়ার এই সব নিগ্রোদের মানুষই জ্ঞান করে না । অন্ধকার আফ্রিকার ঘন অরণ্যের বুক চিরে সাপের মতো এঁকে বেঁকে সুদীর্ঘ অনেকগুলি রেল লাইন বসানো হয়েছে । সভ্যতার বিষবাষ্প ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য ।

মোম্বাসা থেকে আফ্রিকার বিখ্যাত লেক ভিক্টোরিয়া অব্দি হাজার মাইল জুড়ে আদিম অরণ্য । সপ্তাহে দু'দিন এই রেল লাইনের বুক চিরে ঘন আদিম অরণ্যের মধ্যে দিয়ে ট্রেন ছুটে চলে । এমনই এক সন্ধ্যায় ভিক্টোরিয়া লেকের রেলওয়ে কমকর্তারা টাউন হলে এক মিটিঙে বসেছেন । খুবই জরুরি মিটিং । নির্ধারিত সময় অতিক্রান্ত হলেও যে ট্রেনটা মোম্বাসা থেকে আসার কথা সেটি এখনো আসেনি । অথচ তার রওনা নির্ধারিত সময়েই হয়েছে । টেলিগ্রাম মারফত সেটি নিশ্চিত করা হয়েছে ।

তাহলে ? কেন এলো না ট্রেন ? পুরো একটি দিন কেটে গিয়েছে এর মধ্যে । ট্রেনের দেখা নেই । শ'খানেক যাত্রী ছিল ট্রেনটাতে । কি হলো ? ট্রেন কি মাঝপথে ইঞ্জিনের গোলমালে পড়েছে ? যাই হোক, কর্তারা দ্রুত সিদ্ধান্ত নিলেন যে আজ রাতেই রিলিফ ট্রেন রওনা হবে । উদ্ধারে নেমে পড়তে হবে যত দ্রুত সম্ভব ।

সন্ধ্যের একটু পরেই রিলিফ ট্রেন যাত্রা শুরু করলো । পরেরদিন দুপুরের দিকে লেক ভিক্টোরিয়া থেকে প্রায় পাঁচশত মাইল দূরে গভীর জঙ্গলের মধ্যে নিখোঁজ ট্রেনটির সন্ধান মিললো । দ্রুত রিলিফ ট্রেনটি থেকে স্বশস্ত্র গার্ডের একটা দল বেরিয়ে এসে নিখোঁজ ট্রেনটির চতুর্দিকে ছড়িয়ে পড়লো । খুব দ্রুত হঠাৎই গার্ডেদের হুইসল বাজতে লাগলো । ঘন ঘন । বিপদের গুরুত্ব আঁচ করতে পেরে এবার রিলিফ ট্রেন থেকে সেনার একটি দল নেমে গেলো । দ্রুত তৎপরতার সাথে তারা ট্রেনটির চতুর্পাশে প্রহরায় নিযুক্ত হলো ।

এবার রিলিফ ট্রেন থেকে তদন্তকারী দল, সংবাদমাধ্যমের প্রতিনিধি এবং কিছু রেলওয়ে উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা নামলেন । ভিক্টিম ট্রেনটির চালক, গার্ড এবং যাত্রীদের সাথে কথা বললেন । অবশ্য তার আগেই তারা আগের দুই রাতের ঘটে যাওয়া নারকীয় ঘটনার আঁচ করতে পেরেছেন । ইঞ্জিনটি লাইনচ্যুত হয়ে একদিকে হেলে রয়েছে, একটি কামরার কাঠের দরজা ভাঙা । আরেকটি কামরার কাঠের ছাদ ভেঙে পড়েছে। ট্রেনের প্রত্যেক কামরার চারপাশে চাপ চাপ রক্ত, শরীর থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া মানব অঙ্গ প্রত্যঙ্গ আর ইতস্তত ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা অন্তত কুড়িটি সিংহের মৃতদেহ । এসব দেখে যা বোঝার আগেই বুঝে নিয়েছেন তদন্তকারী দল ।

এরপরে ধীরে ধীরে উন্মোচিত হলো এক হৃদয় বিদারক ঘটনা ।

মোম্বাসা থেকে যাত্রা শুরু ঠিকঠাকই হয়েছিল একদম । ছ'টি বড় কামরা আর একটা ওয়াগন নিয়ে যাত্রা শুরু করে ট্রেনটি । যাত্রাপথ বেশ নির্বিঘ্নই ছিল বলা চলে । বিপত্তির সূত্রপাত হয় হঠাৎই একদল পোকাকে কেন্দ্র করে ।

"পোকা !!!", এক রেলওয়ে কর্মকর্তা অবাক বিস্ময়ে বলে ফেললেন ।

"আজ্ঞে হ্যাঁ, পোকা, শুঁয়োপোকা ।", বললেন ইঞ্জিন ড্রাইভার ।

"হঠাৎ দেখি স্যার, সামনে রেল লাইন নেই । সবুজ ঘাস বিছানো । আমি হতভম্ব হয়ে ব্রেক চাপি । ইঞ্জিনের গতি কমে আসতেই তখন বুঝতে পারি যে লাইন কেউ তুলে নেয়নি । সামনে শুঁয়োপোকার বিশাল একটি দল চলেছে রেল লাইন ঢেকে। আমি আর স্যার ট্রেন না থামিয়ে চালিয়ে দিলাম তাদের উপর দিয়েই । আর বিপদের সূত্রপাত সেখান থেকেই ।"

লক্ষ লক্ষ শুঁয়ো পোকা গাড়ির ভারী লোহার চাকার সাথে জড়িয়ে যেতে লাগলো । তাদের চটকানো দেহপিন্ডে অসম্ভব পিচ্ছিল হয়ে গেলো লাইন । চাকা বার বার হড়কে যেতে লাগলো । আরেকটু গতি বাড়ানো মাত্রই হঠাৎ ট্রেনের ইঞ্জিন লাইনচ্যুত হয়ে বিকট একটা শব্দ করে থেমে গেলো ।

যে ওয়াগনটা ট্রেনের সাথে যাচ্ছিলো সেটায় একটা ক্রেন ছিলো । তখন বিকেল বেলা । সব যাত্রী কামরা থেকে নীচে নেমে পড়লো । যুবক ও সমর্থ পুরুষেরা ক্রেনের সাথে ইঞ্জিনটাকে লোহার জয়েস্ট দিয়ে বাঁধার কাজে যোগ দিলো । মেয়েরা এক জায়গায় বসে গল্প করতে লাগলো, কেউ কেউ আশ পাশটা একটু ঘুরে ঘুরে দেখতে লাগলো ।

গার্ডরা এসে বারবার যাত্রীদের কামরায় ফিরে যাওয়ার অনুরোধ করতে লাগলো । তাদের মনে কু গাইছে, ভাবগতিক সুবিধের নয় মোটেও । যাত্রীরা অবশ্য গার্ডদের কথায় মোটেও কান দিলো না । ফকফকে দিনের আলো, কি সুন্দর প্রাকৃতিক পরিবেশ । ভয় কিসের ?

এর মধ্যে দুই ঘন্টার অমানুষিক পরিশ্রমে ইঞ্জিনের সাথে লোহার জয়েস্ট দিয়ে ক্রেন বাঁধা হলো । সবাই নিশ্চিন্ত । আর কয়েকটা মুহূর্ত । এক্ষুনি ক্রেন চালিয়ে ইঞ্জিন লাইনের উপরে তোলা হবে । আর কিছুক্ষনের মধ্যেই যাত্রা শুরু । সূর্যাস্তের সময় আসন্ন তখন। অনেকেই ক্যামেরা বাগিয়ে বনভূমির প্রান্তরে সূর্যাস্তের ছবি তোলায় ব্যস্ত । এমন সময় নিদারুন দুঃসংবাদ পাওয়া গেলো ।

ক্রেনে জ্বালানি অতি সামান্য আছে । ক্রেন চলবে না ।

দ্রুত ডিসিশন নেওয়া হলো সবাই মিলে যে, ক্রেন না চলুক যাত্রীরাই একসঙ্গে ধাক্কা দিয়ে ইঞ্জিন লাইনের উপর তুলে দেবে । সমর্থ পুরুষেরা সবাই কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে লেগে গেলো ইঞ্জিন তোলার কাজে । আর মেয়েরা কাঠকুটো জড়ো করে তাতে অগ্নি সংযোগ করে ছোট ছোট অগ্নিকুন্ড রচনা করলো । সেই আগুনের পাশে বসে কেউ কেউ গল্প করতে লাগলো । আবার কেউ কেউ স্টোভ ধরিয়ে চা, কফি তৈরী করতে লাগলো । বেশ একটা পিকনিক পিকনিক মেজাজ ।

একটি বছর দশ বয়সের ইংরেজ বালক তার মায়ের পাশে বসে বিস্কুট খাচ্ছিলো । অগ্নিকুন্ডের দিকে পিছন ফিরে বসে তারা । এমন সময় একটা চাপা জান্তব গর্জন । হুশ করে একটা অস্পষ্ট আওয়াজ । মা পাশে ফিরে দিকে বাচ্চা নেই । এমন সময় হঠাৎ নিদারুন হৈ চৈ আর বাচ্চার আর্ত চিৎকারে সম্বিৎ ফিরে মা দেখে তার ছেলেকে বিশাল একটা সিংহ মুখে করে নিয়ে যাচ্ছে জঙ্গলের মধ্যে ।

[ক্রমশ...]

Sort:  
 3 years ago 

আপনার ছোট গল্প "রক্তঝরা অভিশপ্ত রাত- ০১" খুবই ভয়ঙ্কর মনে হচ্ছে, বাকিগুলো পড়ার অপেক্ষায় রইলাম। শুভকামনা আপনার জন্য।

 3 years ago 

সভ্যতার বিষবাষ্প ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য ।

এই লাইনের বর্ণনাভঙ্গি টি অসাধারন লেগেছে আমার কাছে।

বাস্তব ঘটনা অবলম্বনে লেখা গল্প। সামনের পর্বে সিংহদের তাণ্ডব অপেক্ষা করছে নিশ্চয়। খুবই কষ্টদায়ক মর্মান্তিক ও হৃদয় স্পর্শী বেদনাদায়ক ঘটনা।

 3 years ago 

গভীর আদিম অরণ্যের মাঝে বিপদগ্রস্থ এতগুলো মানুষের অবস্থান। সিংহর তাণ্ডব। একটি অঘটন। তারপর আবার কি ঘটলো? ভীষণ আগ্রহ নিয়ে পরবর্তী পোষ্টের অপেক্ষায় রইলাম।

 3 years ago (edited)

মনে হচ্ছিল গল্পের ভেতর ঢুকে যাচ্ছিলাম।
ভীষণ খারাপ লাগলো বাচ্চাটাকে সিংহ মুখে করে নিয়ে যাচ্ছে। আসলে তারা যদি সতর্ক থেকে গার্ডদের কথা শুনতো তাহলে এমনটা নাও হতে পারতো। যাক সামনে কি ঘটে জানার অপেক্ষায় রইলাম।

 3 years ago (edited)

দাদা অবশেষে গল্প লিখলেন তাহলে!! সত্যি বলতে কবিতার চাইতে আমার কাছে গল্পই বেশি ভালো লাগে। আর গল্প লেখার হাত আপনার অসাধারণ এটা অস্বীকার করার উপায় নেই। সবচাইতে বেশি ভালো লাগে সত্যি ঘটনা অবলম্বনে রচিত কাহিনী গুলো। অন্ধকারছন্ন এই আফ্রিকা মহাদেশকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে হাজার হাজার অ্যাডভেঞ্চার কাহিনী। বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের চাঁদের পাহাড় তার উৎকৃষ্ট উদাহরণ। সিংহের বাচ্চা চুরির মধ্য দিয়ে ঘটনা বেশ জমে উঠেছে। দেখা যাক শেষ পর্যন্ত কোথায় গিয়ে দাঁড়ায়। অসংখ্য ধন্যবাদ এমন একটি সত্য ঘটনা অবলম্বনে রচিত মৌলিক গল্প শেয়ার করার জন্য।❤️👍

 3 years ago 

বর্ণবাদ নিযে আমরা সবাই মোটামুটি জানি কিন্তু আপনার আজকের লেখার শুরুতেই কথাগুলো পড়ে আবার ভেতরটা নাড়া দিয়ে উঠলো। যাই হোক দাদা আপনার গল্পটা তো আলিফ লায়লার স্টাইলে হয়ে গেল। এমন রোমাঞ্চকর মুহূর্তে আপনি শেষ করলেন যে পরবর্তী পর্বের জন্য আর অপেক্ষা সহ্য হচ্ছে না। মোবাইল ফোন হাতে নিয়ে গল্পটি পড়তে বারবার হাত কেঁপে উঠছিল। লোমহর্ষক এই সত্য ঘটনাটি যেকোনো হলিউড মুভি কেও হার মানাবে। ধন্যবাদ দাদা আমাকে
গল্পটি শেয়ার করার জন্য আশা করি বাকী অংশটুকু দ্রুত পড়তে পারব।

 3 years ago 

দাদা গল্পটি সত্যিই খুবই হৃদয়বিদারক। সিংহটি যে বাচ্চাটিকে মুখে নিয়ে যাচ্ছিল এটা সত্যি খুবই কষ্টদায়ক, যেকোনো মায়ের পক্ষে এটা সহ্য করার মতো না।
আপনি গল্পটি এমন জায়গায় শেষ করলেন যে পরের পর্বের জন্য এখন আর সহ্যই হচ্ছে না দাদা। পরের পর্বের অপেক্ষায় রইলাম।

 3 years ago 

কতোদিন পর গল্প দিলেন দাদা!সত্যিই খুব ভালো লাগছে।দাদা অপেক্ষা করছি নেক্সট পর্বের জন্যে।ভয়ংকর হতে যাচ্ছে আশা করি।ঘটনার আঁচ ও পাওয়া যাচ্ছে অনেকটাই।