বাংলা ভাষার কিছু অপ্রচলিত শিশু ছড়া

in আমার বাংলা ব্লগ2 years ago

ekanore.jpg
উইকিমিডিয়া ক্রিয়েটিভ কমনস লাইসেন্স, আন্ডার ফেয়ার ইউজেস পলিসি : সোর্স


দিন যায়, যুগ পাল্টায় । যুগের সাথে সাথে কত কিছুই যে হারিয়ে যায়, কত কিছুরই যে পরিবর্তন হয় তা একটু ভালো করে নিরীক্ষণ করলে আশ্চর্য হয়ে যেতে হয় । বেশি দিন নয়, আমাদের ছোটবেলাতে মায়ের মুখে, দিদিমা-ঠাকুমার মুখে যেসব ছড়া শুনে বড় হয়েছি সেগুলোর অনেকই এখন বিলুপ্তির পথে । আবার কিছু কিছু ছড়া এখন টিকে রয়েছে কিন্তু, তার কিছু কিছু শব্দ, কিছু কিছু বাক্য পরিবর্তিত হয়ে গিয়েছে । এই পরিবর্তন কিন্তু, শুধুমাত্র এই যুগে সাধিত হয়নি, এই পরিবর্তন বহু যুগ ধরেই হয়ে আসছে । ভাষা একটা নিয়ত পরিবর্তনশীল । বাংলা ভাষাও তার ব্যতিক্রম নয় । যুগে যুগে বাংলা ভাষার সমূহ পরিবর্তন সাধিত হয়ে আসছে । আগেকার বাংলা বানান রীতি, শব্দের গঠন এগুলো যেমন পরিবর্তিত হয়েছে ঠিক তেমনি বাক্য গঠনেও আমূল পরিবর্তন সাধিত হয়েছে । আর তার প্রভাব পড়েছে বাংলা ভাষায় রচিত বিভিন্ন পুস্তকে । ফলশ্রুতিতে বাংলা ছড়াতেও এইসব পরিবর্তনের ছায়া লক্ষ্য করা গিয়েছে ।

একটা সময়ে গ্রাম বাংলার আনাচে-কানাচে যেসব শিশু ভুলানো ছড়া মানুষের মুখে মুখে প্রচলিত ছিল সেগুলোই পরে গ্রন্থাকারে লিপিবদ্ধ হয় । প্রথমদিকে গ্রন্থকার এই সব লোকজ গ্রামীণ বাংলার শিশুদের ছড়াতে ব্যবহৃত ভাষার গাঁথুনি, শব্দের গঠন এবং মূল শব্দের ব্যবহার সম্পূর্ণ অপরিবর্তিত রেখেছিলেন । কিন্তু, কাল ক্রমে ভাষার নিয়ত পরিবর্তনশীলতার স্রোতে গা ভাসিয়েছেন পরবর্তী গ্রন্থকারেরা । তাঁরা এই সব লোকজ শিশু ছড়াতে ভাষার আমূল পরিবর্তন এনেছেন । অনেকাংশে ছড়ার শব্দ, বাক্য এমনকি ছন্দ পর্যন্ত পরিবর্তন করেছেন । এটাই নিয়ম, যুগের সাথে তাল মিলিয়ে চলতে গিয়ে বহু গ্রামীণ লোকজ ছড়া একদমই বাদ পড়ে গিয়েছে । আবার বহু পুরোনো লোকজ ছড়ার সামান্য কিছু পরিবর্তন সাধিত হয়ে এখনো সেগুলো প্রচলিত রয়েছে এবং এই যুগেও সেই সব প্রাচীন ছড়া এখনও সমান ভাবে জনপ্রিয় ।

এই যেমন ধরুন "হাট্টিমা টীম টীম" ছড়াটি । এই ছড়াটির উৎপত্তি সাল অজানা । এটি একটি সুপ্রাচীন লোকজ ছড়া, যেটি এক সময় শুধুমাত্র মানুষের মুখে মুখে প্রচলিত ছিল । সর্বপ্রথম ১৮৯৯ সালে যোগীন্দ্রনাথ সরকার তাঁর "খুকুমণির ছড়া" বইটির ১৩ নম্বর সংস্করণে "হাট্টিমা টীম টীম" ছড়াটি লিপিবদ্ধ করেন ।

বহু গবেষণা করে এই ছড়াটি'র হাট্টিমা টীম টীম কি শ্রেণীর জীব সে বিষয়ে একটা ধারণা পাওয়া গিয়েছে । অবশ্য আমরা ছোটবেলা থেকে শুনে আসছি হাট্টিমা এক ধরণের পাখি, কারণ সত্যিই হাট্টিমা নামে একপ্রকার পাখি আছে বাস্তবে । কিন্তু ছড়ার হাট্টিমা আসলে কোনো পাখি নয় । এটি "হাঁটি হাঁটি টিম টিম" বুঝিয়েছে যেটা মুখে মুখে বেশ কিছুটা পরিবর্তন হয়ে গিয়েছে । গ্রাম বাংলার মাঠে একপ্রকার বড় বড় শামুক পাওয়া যেত, যেগুলোর মাথায় লম্বা লম্বা শিঙের মতো শুঁড় ছিল । হাঁটতো হাঁটতো টিম টিম করে, অর্থাৎ খুব ধীরগতিতে । আর মাঠের ঘাসে বা খড়ের গোড়ায় এক গাদা করে সাদা সাদা ডিম পাড়তো । এটাই হলো মূল ছড়ার প্রতিপাদ্য বিষয় । যদিও আমরা সবাই হাট্টিমা-কে পাখি হিসেবে ভাবতেই পছন্দ করি যার মাথায় খাঁড়া খাঁড়া শিং আছে আর যাঁরা মাঠে ডিম পাড়তে ভালোবাসে ।

Screenshot 2024-04-08 155839.png
১৮৯৯ সালে যোগীন্দ্রনাথ সরকার কর্তৃক প্রকাশিত "খুকুমণির ছড়া" বইটির ১৩ নম্বর সংস্করণের "হাট্টিমা টীম টীম" ছড়া


এবার আসি এই বইয়ের কিছু ছড়া নিয়ে যেগুলো এখন একদম অপ্রচলিত ।


একানোড়ে

"এক যে আছে একানোড়ে,
সে থাকে তালগাছে চড়ে’।
দাঁত দুটো তার মূলোর মত,
পিঠখানা তার কুলোর মত,
কান দুটো তার নোটা নোটা,
চোখ দুটো আগুনের ভাঁটা!
কোমরে বিচুলীর দড়ি,
বেড়ায় লোকের বাড়ী বাড়ী।
যে ছেলেটা কাঁদে,
তারে ঝুলীর ভিতর বাঁধে,
গাছের উপর চড়ে,
আর তুলে আছাড় মারে!"

Screenshot 2024-04-08 160309.png


এক যে রাজা

"এক যে রাজা, সে খায় খাজা,
তার যে রাণী সে খায় ফেণী,
তার যে বেটা, সে খায় পাঁঠা,
তার যে বৌ, সে খায় মৌ,
তার যে ঝি, সে খায় ঘি,
তার যে চাকর, সে খায় পাঁপর,
আর দেয় ঘুম।
তালগাছ পড়ে— দুম্ !"

Screenshot 2024-04-08 160428.png


শ্বশুরবাড়ী যাওয়া

"খোকন যাবে শ্বশুরবাড়ী,
খেয়ে যাবে কি ?
ঘরে আছে গমের ময়দা,
শিকেয় আছে ঘি।
একটু খানি দাঁড়াও খোকন,
জিলিপী ভেজে দি।
খোকন যাবে শ্বশুরবাড়ী
খেয়ে যাবে কি ?
ঘরে আছে তপ্ত মুড়ি
মেনা গাইয়ের ঘি !"

Screenshot 2024-04-08 160611.png


ওরে বাবা

"ওখানে কে রে?
আমি খোকা।
মাথায় কি রে?
আমের ঝাঁকা।
খাস্ নে কেন রে?
দাঁতে পোকা।
বিলুস্ নে কেন রে?
ওরে বাবা!"

Screenshot 2024-04-08 160805.png


বক মামা

"বক মামা, বক মামা,
ফুল দিয়ে যা,
নার্‌‌কেল গাছে কড়ি আছে,
গুণে নিয়ে যা!"

Screenshot 2024-04-08 160944.png


চাঁদের কণা

"সোনামণি সোনা!
আদা দিয়ে মুগের ডাল,
ঘন দুধের ছানা!
চাঁদবদনী চাঁদের কণা,
সবাই বলে দে না-দে না;
দিলে যে আমার ঘর চলে না,
সেই কথাটি কেউ বোঝে না!"

Screenshot 2024-04-08 161118.png


------- ধন্যবাদ -------


পরিশিষ্ট


এই পোস্টটি যদি ভালো লেগে থাকে তো যে কোনো এমাউন্ট এর টিপস আনন্দের সহিত গ্রহণীয়

Account QR Code

TTXKunVJb12nkBRwPBq2PZ9787ikEQDQTx (1).png


VOTE @bangla.witness as witness

witness_proxy_vote.png

OR

SET @rme as your proxy


witness_vote.png


steempro....gif

»»——⍟——««

Sort:  
 2 years ago (edited)

আজকে বুঝলাম এই হাট্টিমাটিম এর ব্যাপার স্যাপার।সত্যিই দাদা,আপনি জিনিয়াস।এ ধরণের ইনফরমেশন গুলো কখনোই হয়তো জানা হতো না আপনি না লিখলে।

Congratulations, your post has been upvoted by @nixiee with a 100 % upvote Vote may not be displayed on Steemit due to the current Steemit API issue, but there is a normal upvote record in the blockchain data, so don't worry.

These are very insightful rhymes you have shared, I was able to understand it better through your write up.

Thanks for sharing this with us Dada ☺️❤️❤️❤️

 2 years ago (edited)

শিশু ছড়া নিয়ে সুলিখিত, আপনার আজকের প্রবন্ধটি অনেক গুরুত্বপূর্ণ। বিলুপ্তপ্রায় ছড়া গুলোকে আপনি অনেকদিন পর আমাদের সামনে হাজির করেছেন দাদা। ছড়া গুলো পড়ে শৈশবে ফিরে গিয়েছিলাম। আপনি যথার্থই বলেছেন,"কাল ক্রমে ভাষার নিয়ত পরিবর্তনশীলতার স্রোতে গা ভাসিয়েছেন পরবর্তী গ্রন্থকারেরা "।যেমন, শ্বশুড় বাড়ি ছড়াটা আমরা পড়েছি অন্যভাবে, এখনো খেয়াল আছে আমার। ছড়াটি ছিল,
খোকা যাবে শ্বশুর বাড়ি
সঙ্গে যাবে কে?
ঘরে আছে হুলো বিড়াল
কোমর বেঁধেছে।
ছড়া নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ আলোচনাটি শেয়ার দিয়ে, আমাদের ভাবনার খোরাক যোগানোর জন্য, আপনাকে অনেক অনেক ধন্যবাদ দাদা। শুভ কামনা আপনার জন্য।

 2 years ago 

এই একই ছড়া আমরা একটু ভিন্ন পড়েছি -

"পুটু যাবে শ্বশুরবাড়ি, সঙ্গে যাবে কে ?
ঘরে আছে হুমো বেড়াল কোমর বেঁধেছে ।"

"খোকা"-র জায়গায় "পুটু" আর "হুলো"-র জায়গায় "হুমো" ।

 2 years ago (edited)

কালের বিবর্তনে অনেক কিছুই পরিবর্তন হয়ে যায়। ছোটবেলায় কতো ছড়া পড়তাম, সেগুলো এখন নেই বললেই চলে। তবে হাট্টিমাটিম ছড়াটি সব বাচ্চারা খুব পছন্দ করতো, এমনকি এখনও করে। হাট্টিমা নামে যে বাস্তবে এক ধরনের পাখি রয়েছে, সেটা আমার জানা ছিলো না। হাট্টিমাটিম ছড়ার প্রতিপাদ্য বিষয় সম্পর্কে জেনে খুব ভালো লাগলো দাদা। তাছাড়া বেশ কয়েকটি অপ্রচলিত শিশু ছড়া দেখে সত্যিই ভীষণ ভালো লাগলো। সবমিলিয়ে পোস্টটি দারুণ হয়েছে দাদা। যাইহোক এতো চমৎকার একটি পোস্ট আমাদের সাথে শেয়ার করার জন্য অসংখ্য ধন্যবাদ আপনাকে।

Posted using SteemPro Mobile

Posted using SteemPro Mobile

 2 years ago 

দাদা সময়ের সাথে সাথে সব কিছুর পরিবর্তন হচ্ছে। তার সাথে মানুষের মন আর মানুষের চলাফেরা সব কিছুর পরিবর্তন হচ্ছে। আর সাথে আমাদের সেইসব ছোট বেলার ছোট ছোট সব ছড়া গুলো। এই ছড়া গুলো দেখলেই যেনও মনে পড়ে যায় শৈশবের কথা।আর এমন ছড়া গুলো পড়িয়ে খাবার খাওয়াতো আর ঘুম পাড়াতো আম্মু।
এক যে রাজা, সে খায় খাজা,
তার যে রাণী সে খায় ফেণী,
তার যে বেটা, সে খায় পাঁঠা,
তার যে বৌ, সে খায় মৌ,
তার যে ঝি, সে খায় ঘি,
তার যে চাকর, সে খায় পাঁপর,
আর দেয় ঘুম।
তালগাছ পড়ে— দুম্ !"
শৈশবে এই ছড়া টা অনেক পছন্দের ছিলও।আর অনেক আনন্দের সাথে পড়তাম। দাদা হাট্টিমাটিম টিম এর বিষয়ে অনেক অজানা তথ্য জানতে পেরে ভালো লেগেছে।

Posted using SteemPro Mobile

 2 years ago 

Screenshot 2024-04-08 193243.png

 2 years ago 

এই ছড়াটিও দারুন লাগলো দাদা। যদিও এর আগে কখনো এই ছড়া শুনিনি। তবে আজকে প্রথমবার ছড়াটি পড়ে ভালো লেগেছে।

Upvoted! Thank you for supporting witness @jswit.

 2 years ago 

ঠিক বলেছেন দাদা, আমরা ছোট কালে যে সব কবিতা দিদিমা ঠাকুমার মুখে শুনেছেন সেগুলো এখন প্রায় বিলুপ্ত হয়ে গেছে। কিছু কিছু আছে কিন্তু কিছু কিছু শব্দ বদলে গিয়েছে ।হাট্টিমা নামে একপ্রকার পাখি আছে যা আপনার পোস্ট পড়ে বুঝতে পারলাম ।একা নরে, এক যে রাজা ,শশুর বাড়ি যাওয়া,ওরে বাবা, বক মামা ,চাঁদের কণা এই কবিতাগুলো আসলে আমি কোনদিন পড়িনি দাদা। আজকে আপনার পোস্টের মাধ্যমে পড়ে অনেক ভালো লাগলো কবিতা গুলো ।ধন্যবাদ দাদা আপনার জন্য শুভকামনা রইল।

Posted using SteemPro Mobile

 2 years ago 

"হাঁটি হাঁটি টিম টিম" এই ছাড়াটি ছোটবেলা থেকে আমরা অনেক শুনেছি। তবে এটা যে একটি শামুক ছিল এটা আজকে প্রথম জানতে পারলাম দাদা। সত্যি দাদা কিছু কিছু ছড়া আছে যেগুলো লোকমুখের প্রচলিত ছড়া। আর সময়ের সাথে সাথে কিছু কিছু শব্দ পরিবর্তন হয়ে নতুন রূপ নিয়েছে। দারুন সব ছড়াগুলো দেখে অনেক ভালো লাগলো দাদা।